ভারতের রাজস্থানে সরকারি সরবরাহকৃত কাশির সিরাপ খেয়ে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে এবং অন্তত ১০ শিশু অসুস্থ হয়েছে। এমনকি সিরাপের নিরাপত্তা প্রমাণ করতে তা খাওয়ার পর এক চিকিৎসকও অজ্ঞান হয়ে পড়েন। গত দুই সপ্তাহে এ ঘটনাগুলো ঘটে বলে রাজ্য স্বাস্থ্য বিভাগ নিশ্চিত করেছে।
সিরাপটিতে ডেক্সট্রোমেথরফান হাইড্রোব্রোমাইড নামের উপাদান ছিল। এটি কেসন ফার্মা নামের একটি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রাজস্থানের জন্য তৈরি করেছিল। সোমবার সিকার জেলার পাঁচ বছরের শিশু নীতিশ এই সিরাপ খাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মারা গেলে বিষয়টি আলোচনায় আসে।
নীতিশর পরিবার জানায়, সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত শিশুটিকে গত রোববার চিরানা কমিউনিটি হেলথ সেন্টারে (সিএইচসি) নেওয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসক তাকে ওই সিরাপ খাওয়ানোর পরামর্শ দেন। রাতে মা শিশুটিকে সিরাপ খাওয়ানোর পর সে ঘুমিয়ে পড়ে। রাত ৩টার দিকে একবার হেঁচকি তোলার পর আবার ঘুমিয়ে যায়। সকালে আর তাকে জাগানো যায়নি। তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
নীতিশর চাচা প্রিয়কান্ত শর্মা ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভিকে বলেন, ‘সেদিন সন্ধ্যায় নীতিশ ঠিকই নবরাত্রি উৎসবে গিয়েছিল। রাতে কাশির কারণে তাকে সিরাপ খাওয়ানো হয়। ভোরে বুঝতে পারলাম, সে আর জাগছে না।’
আগের মৃত্যুও একই সিরাপে
নীতিশর মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হওয়ার পর গত ২২ সেপ্টেম্বর মারা যাওয়া আরেক শিশুর পরিবারও বুঝতে পারে, তাদের সন্তানের মৃত্যুর কারণও একই সিরাপ।
ভরৎপুর জেলার মালহা গ্রামের দুই বছরের শিশু সম্রাট জাতভ ও তার দুই আত্মীয়—সাক্ষী ও বিরাট—কাশিতে আক্রান্ত হলে তাদের মা জ্যোতি স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে একই সিরাপ আনেন। দুপুরে খাওয়ানোর পর তিন শিশুই ঘুমিয়ে পড়ে। পাঁচ ঘণ্টা পরও জাগেনি দেখে পরিবার উদ্বিগ্ন হয়। শেষ পর্যন্ত সাক্ষী ও বিরাটকে জাগানো সম্ভব হলেও তারা সঙ্গে সঙ্গে বমি করে। সম্রাট আর জাগেনি। হাসপাতালে নেওয়ার পর সেখান থেকে জয়পুরের জেকে লন হাসপাতালে পাঠানো হলে সেদিনই তার মৃত্যু হয়।
সম্রাটের দাদী নেহনি জাতভ বলেন, ‘আমরা বুঝতেই পারিনি সিরাপটি এত ভয়ঙ্কর। নাতিদের তিনজনই খেয়েছিল। দু’জন বেঁচে গেলেও সম্রাটকে হারালাম।’
নিরাপদ প্রমাণে খেয়ে অজ্ঞান ডাক্তার
বায়ানা এলাকার তিন বছরের শিশু গগন কুমার ওই সিরাপ খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে তার মা সিরাপটি প্রেসক্রাইব করা সিএইচসির দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক ডা. তারাচন্দ যোগীর কাছে অভিযোগ করেন।
নিজের পরামর্শের পক্ষে আত্মবিশ্বাসী চিকিৎসক যোগী সিরাপটি নিজেই খান এবং প্রমাণ করতে একজন অ্যাম্বুল্যান্স চালক রাজেন্দ্রকেও খাওয়ান। পরে গাড়ি চালিয়ে বের হওয়ার সময় তিনি ঘুমঘুম অনুভব করে রাস্তার ধারে গাড়ি থামিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তার পরিবার মোবাইল ফোনের লোকেশন ট্র্যাক করে আট ঘণ্টা পর গাড়ির ভেতর অচেতন অবস্থায় তাকে খুঁজে পায়।
অ্যাম্বুল্যান্স চালকও সিরাপ খাওয়ার তিন ঘণ্টা পর একই রকম উপসর্গে আক্রান্ত হন, তবে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হন।
গত সপ্তাহে রাজস্থানের দক্ষিণাঞ্চলীয় বান্সওয়ারা জেলায়ও এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী আট শিশু ওই সিরাপ খাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।
সরকারের পদক্ষেপ
ঘটনার পর রাজস্থান সরকার সিরাপটির ২২টি ব্যাচের বিক্রি ও বিতরণ নিষিদ্ধ করেছে। স্বাস্থ্য দফতর জানিয়েছে, গত জুলাই থেকে এ পর্যন্ত রাজ্যে ১ লাখ ৩৩ হাজার বোতল সিরাপ বিতরণ করা হয়েছে। জয়পুরের এসএমএস হাসপাতালে মজুত থাকা ৮,২০০ বোতলও রোগীদের না দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বান্সওয়ারার মহাত্মা গান্ধী সরকারি হাসপাতালের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. প্রদ্যুমন জৈন এনডিটিভিকে বলেন, ‘যে ওষুধটি শ্বাসকষ্ট ও অতিরিক্ত ঘুমভাবের কারণ বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, সেটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ডোজও সমস্যা বাড়াতে পারে। বেশিরভাগ শিশুই চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে উঠেছে।’
রাজস্থান মেডিক্যাল সার্ভিসেস করপোরেশনের গুণমান নিয়ন্ত্রণ বিভাগের নির্বাহী পরিচালক জয় সিংহ বলেন, ‘ডাক্তারদের ওই সিরাপ প্রেসক্রাইব করতে নিষেধ করা হয়েছে। ২২টি ব্যাচের নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে এবং কেসন ফার্মা থেকে সরবরাহ বন্ধ করা হয়েছে।’
রাজস্থানের ড্রাগ কন্ট্রোলার অজয় ফাঠক জানান, একই কোম্পানির আরেকটি কফ সিরাপ ২০২৩ সালে নিম্নমানের মেনথল থাকার কারণে নিষিদ্ধ হয়েছিল।
এনডিটিভি জানিয়েছে, কেসন ফার্মার কারখানায় গেলে সেটি বন্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। কোম্পানির মালিক বিরেন্দ্র কুমার গুপ্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।