বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর পার্শ্ববর্তী সাভারের আশুলিয়া থানার সামনে ভ্যানের ওপর ৬টি লাশ পোড়ানো হয়। সেই লাশ পোড়ানোর তালিকায় ছিল সাজ্জাদ হোসেন সজল। সজলকে জীবিত অবস্থায় পোড়ানো হয়। আন্দোলন চলাকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে হওয়া মামলায় গতকাল রোববার শহীদ সজলের মা শাহীনা বেগম ট্রাইব্যুনালে তার সাক্ষ্য প্রদান করেন।
সাক্ষ্যে শাহীনা বেগম বলেছেন, ‘ভ্যানের ওপর থেকে সজলের লাশ যখন নামানো হয়, তখন তার সঙ্গে থাকা কর্মস্থলের আইডি কার্ডের আংশিক পোড়া অংশ এবং তার মানিব্যাগের ভেতরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ড দেখে আমি ছেলে সজলের লাশ শনাক্ত করি। আমার ছেলের লাশের যখন প্রথম ছবি তুলি, সেখানে আমি দেখতে পাই তার পোড়া হাতের পাশেই তার মোবাইল ফোনটি রয়েছে। এটা দেখে, বুঝতে পারি, পোড়ানোর পূর্ব মুহূর্তেও সে জীবিত ছিল এবং ফোন নিয়ে কাউকে কিছু জানানোর চেষ্টা করছিল। আমার মনে হয়েছে, যখন ওকে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল, তখন সে প্রাণপণে তার অবস্থান আমাদের জানানোর চেষ্টা করছিল বা কোনো মেসেজ লেখার চেষ্টা করছিল; কিন্তু একটির ওপর আরেকটি লাশের নিচে পড়ে যাওয়ায় সে আর কোনো মেসেজ লেখা বা কল দেওয়ার সুযোগ পায়নি।’
এদিন শাহীনা বেগম ছাড়া আরও তিনজনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়। বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। এর আগে তিন দিনে এ মামলায় পাঁচজনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষ হয়। গতকাল পর্যন্ত এ মামলায় মোট নয়জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষ হয়েছে। আজ সোমবার এ মামলার আরও তিনজনের সাক্ষ্যগ্রহণ হওয়ার কথা রয়েছে। আগামী অক্টোবরের মধ্যেই এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ ও সাক্ষীদের জেরা শেষ হওয়ার আশা প্রসিকিউশনের।
শুনানি শেষে প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আগামী অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে এই মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হবে বলে আশা করছি। তার সঙ্গে শুনানিতে ছিলেন প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম, প্রসিকিউটর বি এম সুলতান মাহমুদ প্রমুখ। দুই পলাতক আসামির পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। আর এই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় থাকা আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।
আশুলিয়ায় নারী ও শিশু হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতা কর্মী শাহীনা বেগম তার সাক্ষ্যে আরও বলেছেন, ‘হাসপাতালে অনবরত গুলিবিদ্ধ রোগী আসছিল। তখন আমি বারবার ছেলেকে ফোন করে বলি, বাবা তুমি বাসায় ফিরে আসো। হাসপাতালে অনেক গুলিবিদ্ধ আহত রোগী আসছে, তোমার আন্দোলনে থাকার দরকার নেই। তখন সে আমাকে বলে, তুমি এমন স্বার্থপর কেন আম্মু? আমি এখন বাসায় যেতে পারব না। আমার সামনে চার চারটি লাশ এবং আমি একজন আহতকে ধরে বসে আছি। বেলা ১১ থেকে সাড়ে ১১টার দিকে আমার হাসপাতালে দুটি ডেডবডি আসে। অনেক আহত রোগী আসে। তখন আমি আমার ছেলেকে আবার ফোন করি। তখন ছেলে বলে, আমাকে তুমি কীভাবে ফেরত আসতে বলো। আমি তখন বলি তুমি আমার একমাত্র ছেলে। তোমার একটি মেয়ে আছে। তোমাকে আমি ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চাই; কিন্তু সে বাসায় ফিরে আসেনি। তখন সে আমাকে জবাব দেয়, মা আমি যদি মারা যাই, তাহলে হাজার সন্তান তোমার পাশে দাঁড়াবে। তুমি আমার চিন্তা কর না।’
সাক্ষীর জবানবন্দিতে শাহীনা বেগম বলেন, সন্ধ্যা আনুমানিক ৭টার দিকে হাসপাতাল থেকে আমি ছেলের খোঁজে সজলের এক বন্ধু শান্তকে নিয়ে বের হই। আমি আশপাশে যত হাসপাতাল আছে সব হাসপাতালে ছেলের খোঁজ করি কিন্তু পাইনি। আমি আইসিইউতে ঢুকেও রোগীদের মুখ দেখে ছেলেকে খুঁজেছি। সব বেওয়ারিশ লাশ ছিল, তা আমি উল্টে-পাল্টে দেখেছি। তারা আমাকে লাশ দেখতে নিষেধ করছিল কারণ তারা বলছিল আপনি মা, আপনি সহ্য করতে পারবেন না। নিহতদের মাথায়, বুকে গুলি লেগে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এগুলো দেখলে আপনি পড়ে যেতে পারেন। আমার স্বামীও বিভিন্ন হাসপাতালে ছেলের সন্ধানে খোঁজখবর করে কিন্তু ছেলের সন্ধান পাওয়া যায়নি। সারা দিন এবং রাত ৩টা ৫০ পর্যন্ত খোঁজাখুঁজি করে আমি বাসায় ফেরার উদ্দেশ্যে বাইপাইল মোড়ে আসি। তখন আমি সেখানে লাঠিসোটা নিয়ে পাহারারত ছাত্রদের দেখতে পাই। তাদের কাছে আমার ছেলের সন্ধান জানতে চাই এবং আমার মোবাইলে থাকা ছবি তাদের দেখাই। তখন একজন ছেলে আমাকে বলে, আন্টি আপনি যদি সহ্য করতে পারেন তাহলে আমি আপনাকে একটা খবর বলতে চাই। তখন আমি বললাম বাবা আমি আমার ছেলেকে পাওয়ার জন্য সব কিছু সহ্য করতে প্রস্তুত আছি, তুমি বলো। তখন সে ছেলেটি আমাকে বলে, আশুলিয়া থানার সামনে ৬-৭টি ছেলেকে হত্যা করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আপনি সেখানে আপনার ছেলেকে খুঁজে দেখতে পারেন। আমি আশুলিয়া থানায় যেতে চাইলে অন্য ছাত্ররা আমাকে সেখানে যেতে দেয়নি। তারা আমাকে জোর করে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। আমি বাসায় গিয়ে তাহাজ্জুদ ও ফজরের নামাজ পড়ে ৬টার দিকে বাসা থেকে আবার বের হই এবং সকাল আনুমানিক সাড়ে ৬টার দিকে আশুলিয়া থানার সামনে যাই। সেখানে গিয়ে একটি পুলিশের পিকআপ গাড়িতে বেশ কয়েকটি পোড়া লাশ দেখতে পাই। অনেক মানুষ লাশগুলোর ছবি ও ভিডিও করছিল। আমি ভিড় ঠেলে সামনে যাই এবং একটি ছবি তুলি। আমি দেখতে পাই একটি লাশ এমনভাবে পুড়ে গেছে যে, পায়ের একটি মোটা হাড় উঁচু হয়ে আছে এবং সে হাড়ের সঙ্গে একটি জুতা পোড়া অবস্থায় ঝুলছে। সামান্য টাচ করলেই জুতাটা পড়ে যাবে। জুতাটা দেখেই আমি বুঝতে পারি যে, এই জুতাটি আমার ছেলে সজলের জুতা। (এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন শহীদ সজলের মা। অশ্রুসিক্ত হন ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত অনেকেই।)
এরপর শাহীনা বেগম বলেন, আমি তখন উপস্থিত সেনা সদস্যদের বলি, এটাই আমার ছেলের লাশ। দয়া করে আমার ছেলের লাশ আমাকে দিয়ে দিন। তখন সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাকে বলেন, এখন লাশ দেওয়ার অনুমতি নেই। অনুমতি পাওয়া গেলে আপনাকে জানাব। আমি নিরুপায় হয়ে আমার ছেলের লাশ ফেরত পাওয়ার জন্য আমার কর্মস্থলের হাসপাতালের ডাক্তারদের সহায়তা করার অনুরোধ করি। বিকেল আনুমানিক সাড়ে ৪টার দিকে সজলের বন্ধুরা আমাকে ফোন দিয়ে যেখানে লাশ পোড়ানো হয়েছিল, সেখানে আসতে বলে। আমি সেখানে ৫টার দিকে গিয়ে পৌঁছাই। তখন গাড়ি থেকে একটার পর একটা পোড়া লাশ নামানো হয় এবং শনাক্ত করার চেষ্টা করা হয়।। সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাকে লাশের কাছে যেতে দেয়। সজলের লাশ যখন নামানো হয়, তখন তার সঙ্গে তার কর্মস্থলের আইডি কার্ডের আংশিক পোড়া কার্ড এবং তার মানিব্যাগের ভেতরে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ড দেখে আমি আমার ছেলে সজলের লাশ শনাক্ত করি।’ শহীদ সজলের মা বলেন, আমার সন্তানসহ ২ হাজার মানুষকে যারা হত্যা করেছে, সেই আসামিরাসহ এ হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইজিপি মামুন, ওবায়দুল কাদের, সাইফুল এমপি, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ এবং পুলিশ লীগের বিচার চাই।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গত ১ জুন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। শেখ হাসিনার পাশাপাশি এই মামলায় অভিযুক্ত সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের ৫টি অভিযোগ এনে অভিযোগ গঠনের আবেদন করে প্রসিকিউশন।
গত ১৬ জুন ট্রাইব্যুনাল-১ পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে হাজির হতে একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেন এবং পরদিন দুটি পত্রিকায় শেখ হাসিনা ও কামালকে ৭ দিনের মধ্যে আত্মসমর্পণ করতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। তবে বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পরেও পলাতক দুই আসামি ট্রাইব্যুনালে হাজির না হওয়ায় তাদের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী দিয়ে এই মামলায় অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য করেন। সে অনুযায়ী শুনানি শেষে গত ১০ জুলাই এই মামলায় অভিযোগ গঠন করে আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১। এ ছাড়া এই মামলায় দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্যতা উদ্ঘাটনে (অ্যাপ্রুভাল) রাজসাক্ষী হতে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের আবেদন মঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে প্রথম মামলাটি (মিস কেস বা বিবিধ মামলা) হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। এই মামলাটি ছাড়াও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরও দুটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে গুম-খুনের ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে। অন্য মামলাটি হয়েছে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়।