এনসিপির যুব উইং জাতীয় যুবশক্তির নেতা কে এম মামুনকে (মাওলানা মামুনুর রশীদ) তুলে নিতে দুই ধাপে ৬ জন কাজ করেছে। প্রথমে তিনজন ব্যক্তি তাকে বলেন, ‘ভাই একটু আসবেন। কাঁচা বাজারে দুর্নীতি নিয়ে কিছু কথা বলব। আপনি আসলেই দেখতে পাবেন কিভাবে এ দুর্নীতি হয়।’ তাদের সঙ্গে হেঁটে বাজারের সামনে মামুন এগোলে কিছু সময় পরেই একটি হাইস গাড়ি এসে পাশে দাঁড়ায়। গাড়িটি ছিল সাদা রঙের, কালো গ্লাসের। গাড়িটির দরজা খুলে ধাক্কা দিয়ে তুলে ফেলেন মামুনকে। পরে একটি ছবির মত কাগজ দেখানোর সাথে সাথেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন মামুন। এরপরেই তাকে চোখ বেঁধে কোথায় নিয়ে গেছেন আর বলতে পারেননি।
জানা গেছে, অটোতে তিনজন এবং হাইস গাড়ির ভেতরে থাকা তিনজনসহ মোট ৬ জন তাকে তুলে নিয়ে যান। অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়ার পর তার সব সময় চোখ বাঁধা থাকতো, শুধু টয়লেট-বাথরুম গিয়ে যাওয়ার সময় চোখ খোলা হত। চোখ বাঁধা থাকায় ছয়জনের কাউকে চিনতে পারেননি তিনি। এরপর হাত-পা ও চোখ বেঁধে একটি কক্ষে আটকে রাখা হয় তাকে।
তুরাগ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সাদিকুর রহমান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা খবর পেয়ে পূর্বাচলের নীলা মার্কেট সংলগ্ন ভোলানাথপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে অচেতন অবস্থায় কে বা কারা ফেলে রেখে যায়। স্থানীয়দের খবর পেয়ে অসুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করি। এরপর তাকে চিকিৎসার জন্য কুয়েত মৈত্রীর হাসপাতালে নিয়ে যাই। তার পরিবারের সদস্যদের খবর দিয়ে তার পরিবারের কাছে মামুনকে বুঝিয়ে দেয়া হয়।
তোর জন্য এত লোক পোস্ট কেন দেয়
নিখোঁজের ৫ দিন পর মামুনকে রাজধানী ঢাকার পূর্বাচলের তিনশ ফিট থেকে গত শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) সকালে উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খালা বাহিনী। এ ঘটনায় তুরাগ থানায় মামুনের স্ত্রী খাদিজা সাধারণ ডায়েরি করলেও এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
অজ্ঞাত স্থানে থাকা অবস্থায় মানুনকে খুঁজে না পেয়ে শাহবাগে মানববন্ধনসহ মিডিয়াতে আলোচনা ও আন্দোলন করায় নেতাকর্মী পোস্ট দেয়ার ক্ষিপ্ত হয়ে তুলে নেওয়ারা জিজ্ঞেস করেন, তোর পক্ষে মেঘমল্লার বসু, হাসনাত, জামায়াতের আমিরসহ এত লোক তোমার পক্ষে কেন পোস্ট দেয়, তাকে মারতে মারতে বলতো তোকে তো ভাবছিলাম ছোট নেতা। কিন্তু তোর জন্য এত লোক পোস্ট কেন দেয়।
গত বৃহস্পতিবার জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে উদ্বেগ জানিয়ে লেখেন, ‘রাষ্ট্র যেখানে ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে ঘটনার দ্রুত ও সুষ্ঠু তদন্তে সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর গাফিলতি স্পষ্ট।
কাটছে না ট্রমা
মামুনের পরিবার জানায়, গত ২১ সেপ্টেম্বর সকালে পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে বাসা থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ হন মামুন। ২১ সেপ্টেম্বর রাতে একটি অচেনা নম্বর থেকে তাকে সরাসরি অপহরণের হুমকি দেওয়া হয়। পরের দিন ২২ সেপ্টেম্বর ভোরে রাজধানীর তুরাগের হানিফ আলী মোড় এলাকার বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন মাওলানা মামুনুর রশীদ।
পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজে দেখতে পায়, ২২ সেপ্টেম্বর সকাল সোয়া ৬টার দিকে তিনি একটি অটোরিকশায় করে বের হন। তিনি তুরাগ থানা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানে উত্তরার রাজপথে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। এ ঘটনায় তুরাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন মাওলানা মামুনের স্ত্রী খাদিজা।
আজ সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) বৈষম্যবিরোধী নেতা মামুনের স্ত্রী খাদিজা বেগম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, উদ্ধারের পর মামুনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে তিনি চিকিৎসাধীন আছেন। গতরাতে দুবার আর আজ সকালে তিনবার অজ্ঞান হন। ঘন ঘন বমি হচ্ছে। শরীর একেবারে দুর্বল হওয়ায় ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছেন না।
আগের রাতে হুমকি, পরের দিন গুম
উদ্ধারের পর মামুনের বরাত দিয়ে পুলিশ ও তার বন্ধুমহল এবং তার পরিবার জানান, অপরিচিত দুজন সামনে আসতো বাকি চারজন সামনে আসেনি। তার মোবাইল নিয়ে মোবাইলে অনলাইনে চেক করে যখন জানতে পারে মামুন গোয়েন্দা সংস্থা ডিবি, এনএসআই, ডিজিএফআইর মত গোয়েন্দা সংস্থার দের তথ্য দিতো যে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা কে কোথায় থাকতো ও ছাত্রদের উপর কে আঘাত করেছে সে জানাতো। এই তথ্যগুলো পাওয়ার পরে তাদেরকে আরো বেশি মারধর ও বকাবকি বেশি করাতো।
ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. মহিদুল ইসলাম জানান, মাওলানা মামুনুর রশীদকে অসুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করেছি। চিকিৎসার জন্য তাকে কুয়েত মৈত্রীর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ডিসি আরও বলেন, সুস্থ হলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে তিনি কীভাবে নিখোঁজ হন। পরে এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিষয়টি বিস্তারিতভাবে গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরা হবে।
প্রজন্ম লীগের সভাপতি যুবশক্তিতে যোগদানের চেষ্টা
পরিবার ও বন্ধুমহলের ধারণা, এই গুমের পেছনে গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের হাত আছে। মামুনের চোখ বাঁধা অবস্থায় মামুন শুনতে পান তাকে ধরে নিয়ে আসা চারজন ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছিল। ছাত্র আন্দোলনের সময় ব্রিজের উপরে পুলিশকে ঝুলিয়ে রাখার যে ছবি প্রকাশ করা হয়েছিল, সেখানে মামুনের ছবি আছে বলে জানান তারা। এখন তাকে জঙ্গি নাটক সাজিয়ে ভারতে পাচার করে দেয়ার ব্যাপারে পরামর্শ দিতে বলতে শুনেছেন তিনি।
তাদের অনুমান, মামুনকে তুলে নেওয়ারা মেয়র জাহাঙ্গীরের সাথে কথা বলেছে এবং তিনি বিষয়টা হ্যান্ডেলিং করেছে। মামুন আওয়ামী লীগের লোকদেরকে ধরিয়ে দিত এই অভিযোগে। পলাতক হাসিনার আমলে ছাত্র আন্দোলন দমানোর জন্য প্রজন্ম লীগ নামের এক সংগঠন দাঁড় করায় আওয়ামী লীগ সরকার। সে সময় তুরাগ থানায় প্রজন্ম লীগের সভাপতি ছিলেন সাব্বির। ৫ আগস্টের পর সেই তথ্য গোপন রেখে এখন এনসিপির যুবশক্তির পদে থাকার জন্য ব্যস্ত ছিলেন তিনি।
এই চেষ্টা-প্রচেষ্টা করা দেখে মামুন সাব্বিরের বিরুদ্ধে জুলাইয়ের আগের অপকর্মগুলো প্রকাশ করেন। এনসিপিকে জানানো হয়, এত অপকর্ম করে সাব্বির পুনরায় কিভাবে যুবশক্তিতে জায়গা পায়। তার বিরুদ্ধে ফেসবুকে পোস্টও করেছিলেন মামুন। এই পোস্ট করাটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মামুনের স্বীকারোক্তিতে পরিবারের এক সদস্য জানায়, মেয়র জাহাঙ্গীরের সঙ্গে ফোনে তারা (তুলে নেওয়ারা) জানায়, অনুমতি দিলে যুবশক্তির ৪০ জনের (কমিটি) ভেতরে দুজনকে আমরা দেখে নেব। মামুনকে আগের দিন হুমকি দিয়েছে তাকে গুম করার জন্য। পরদিন তিনি গুম হয়ে যায়। খুবই পরিকল্পিতভাবে এই গুম করা হয়েছে। কিন্তু আমরা জিডি করার সময় সন্দেহভাজন নাম দেওয়ার পরেও এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। তা না করে ঘটনাটি ভিন্ন ক্ষেত্রে নেওয়ার চেষ্টা করছে। মামুনকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করলে তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত জানানো হলেও পুলিশ কিছু জানাতে চায়নি এবং কাউকে গ্রেফতারও করা হয়নি। পুলিশ এতটুকু বলেছে, মামুন সুস্থ হলে বিস্তারিত জানানো হবে।