১০০ বছর বয়সে পৌঁছানো সত্যিই এক অসাধারণ অর্জন। বিশেষত যখন সেই জীবন কেটেছে রাজনীতি, চাপ আর দায়িত্বের ভিড়ে। ২০২৫ সালের ১০ জুলাই মালয়েশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ শতবর্ষে পা দিলেন। বয়স তো বটেই, তার চেয়ে বেশি বিস্ময়কর হলো,এখনও তার কথা বলার স্পষ্টতা, চিন্তার ধার, আর চারপাশের পৃথিবীর সঙ্গে সক্রিয় সম্পৃক্ততা। এই বয়সেও তিনি জানালেন, কীভাবে শৃঙ্খলা আর সচেতন জীবনযাপনের মাধ্যমে সুস্থভাবে শতায়ু হওয়া যায়।
এখানে নেই কোনো গোপন ওষুধ বা বাড়াবাড়ি করা নিয়ম। আছে কেবল জীবনকে সঠিকভাবে বাঁচার কৌশল। মাহাথিরের কাহিনি শুধু শত বছর বেঁচে থাকার নয়, বরং কীভাবে তিনি শরীর ও মনকে ভেঙে পড়তে দেননি, সেটাই আসল শিক্ষা।
শরীরকে রাখুন সক্রিয়, তবে অতিরিক্ত নয়
“সক্রিয় থাকতে হবে। বসে থেকে শরীরের ক্ষতি হয় এমন কিছু করা উচিত নয়,” বলেন মাহাথির দ্য স্ট্রেইটস টাইমস-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে।
তিনি জিমে গিয়ে কঠিন ব্যায়াম করেন না। বরং হাঁটা, মিটিংয়ে যোগ দেওয়া কিংবা নিত্যদিনের ছোটখাটো কাজকর্মের মাধ্যমেই শরীর সচল রাখেন। চিকিৎসকরা বলেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের পেশি ও হৃদযন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। নিয়মিত হালকা চলাফেরা—যেমন হাঁটা বা ঘরের কাজ—এগুলোই রক্তসঞ্চালন স্বাভাবিক রাখে আর শরীরকে শক্ত রাখে। গবেষণা বলছে, এই ধরনের হালকা দৈনিক কর্মকাণ্ড বয়স্কদের জন্য বেশি কার্যকর, যা পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি, স্মৃতিভ্রংশ আর দুর্বলতা কমায়।
মস্তিষ্ককেও দিতে হবে কাজ
“যদি মস্তিষ্ক ব্যবহার না করেন, এটা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে, ভুলে যেতে থাকে… আমি পড়ি, লিখি, মানুষের সঙ্গে কথা বলি, বক্তৃতা দিই,” জানালেন তিনি।
তার কাছে এগুলো কোনো বাড়তি কাজ নয়, বরং মস্তিষ্কের খোরাক। তিনি প্রতিদিন পড়াশোনা করেন, নতুন বিষয় নিয়ে লেখেন এবং আলোচনায় অংশ নেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত পড়াশোনা, লেখা বা আলোচনায় যুক্ত থাকেন, তারা অনেক কম ঝুঁকিতে থাকেন ডিমেনশিয়ার মতো সমস্যায়। মস্তিষ্কও শরীরের পেশির মতো, যত বেশি ব্যবহার হয়, ততই শক্ত থাকে। ১০০ বছর বয়সেও মাহাথিরের স্বচ্ছ চিন্তা তার প্রমাণ।
অবসরের পরও উদ্দেশ্যময় জীবন
পদ ছাড়লেও তিনি কখনো থেমে যাননি। এখনও লেখেন, মতামত দেন, জনআলোচনায় অংশ নেন।
তার কাছে অবসর মানে দায়িত্ব ফেলে দেওয়া নয়, বরং নতুনভাবে নিজেকে কাজে লাগানো। গবেষণায় প্রমাণিত, জীবনের শেষ ভাগে যারা অর্থপূর্ণ কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়ে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার একটি উদ্দেশ্য থাকাটাই দীর্ঘায়ুর নীরব রহস্য।
মানসিক দৃঢ়তা আর শৃঙ্খলা
মাহাথিরের রাজনৈতিক জীবন ছিল চ্যালেঞ্জে ভরা। সমালোচনা, চাপ, আন্তর্জাতিক সংকট—সবকিছুর মধ্যেও তিনি শান্ত থেকেছেন।
যদিও তিনি ধ্যান বা যোগব্যায়ামের কথা বলেন না, তবে চাপের সময় নিজেকে সংযত রাখাই ছিল তার শক্তি। চিকিৎসকরা বলেন, দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ শরীরের কোষকে দ্রুত বার্ধক্যের দিকে ঠেলে দেয়। তাই চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখাই দীর্ঘায়ুর একটি বড় চাবিকাঠি।
ক্ষতিকর অভ্যাস থেকে দূরে থাকা
মাহাথির সবসময়ই পরিমিত খাবার খেয়েছেন, ধূমপান আর অ্যালকোহল থেকে দূরে থেকেছেন। কোনো ট্রেন্ডি ডায়েট নয়, বরং সাধারণ ও সুষম খাবারই তার ভরসা।
গবেষণায় দেখা গেছে, বয়স্করা যদি খাবারে পরিমিতি মেনে চলেন, তবে ডায়াবেটিস বা হৃদরোগের মতো জটিলতার ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।
কৌতূহল আর শেখার আগ্রহ
আজও তিনি নতুন প্রজন্মের সঙ্গে কথা বলেন, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন, শিখে চলেন। বয়স কখনো তাকে শেখার পথে থামাতে পারেনি।
বিজ্ঞানীরা বলেন, শেখার প্রতি আগ্রহ মস্তিষ্কের নতুন স্নায়ু সংযোগ তৈরি করে, যা বৃদ্ধ বয়সেও মস্তিষ্ককে সতেজ রাখে।
১০০ বছর বয়সেও ড. মাহাথির মোহাম্মদ শুধু একজন রাজনৈতিক কিংবদন্তি নন, বরং প্রমাণ যে শৃঙ্খলা, উদ্দেশ্য আর কৌতূহল জীবনে রাখলে বয়স কেবলই একটি সংখ্যা হয়ে যায়। তার এই জীবনযাপন থেকে আমরা শিখতে পারি দীর্ঘায়ু কোনো কাকতাল নয়, বরং সচেতন অভ্যাসেরই ফসল।