নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে নিহত হয়েছে ফয়সাল হোসেন (২২) নামে এক বাংলাদেশি তরুণ। গত শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) রাতে খাইবার পাখতুনখোয়ার কারাক জেলায় পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে ১৭ টিটিপি সদস্য নিহত হয়। এদের মধ্যেই একজন ছিল ফয়সাল হোসেন।
বিজ্ঞাপন
রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর) এ খবর জানাজানি হলে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয় বিভিন্ন মহলে।
এদিকে সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) নিহত জঙ্গি সদস্য ফয়সাল হোসেনের পরিবারে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, তার মা জানতেন যে সে দুবাই প্রবাসী। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে তার মৃত্যু হয়েছে, এটা কোনোভাবেই মানতে পারছেন না পরিবারের সদস্যরা।
বিজ্ঞাপন
ফয়সাল মাদারীপুর সদর উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নে ছোট দুধখালী এলাকার আবদুল আউয়াল মোড়লের ছেলে। তার পরিবারের সদস্যরা রাজধানীর জগন্নাথপুর এলাকার আজিজ সড়কে বসবাস করেন। আবদুল আউয়াল পেশায় একজন ইলেকট্রিশিয়ান। তার বড় ছেলে আরমান মোড়ল একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন।
গত শুক্রবার রাতে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের কারাক জেলায় পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর এক অভিযানে ১৭ টিটিপি সদস্য নিহত হন। এ সময় বাংলাদেশি তরুণ ফয়সাল হোসেনও নিহত হন। রোববার দুপুরে নিহত তরুণের বড় ভাই আরমান মোড়ল তার ভাইয়ের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হন।
বিজ্ঞাপন
সোমবার সকাল ১০টার দিকে ফয়সালের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, ফয়সালের পরিবারের সদস্যরা ভোরে ঢাকা থেকে মাদারীপুরের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। ১১টার দিকে ফয়সালের মা চায়না বেগম (৪৫) বাড়িতে প্রবেশ করেন। তখনো তিনি জানতেন না তার ছোট ছেলে ফয়সাল মারা গেছেন। তিনি শুনেছিলেন, তার ছেলে দুবাইতে অসুস্থ। ফয়সালের মৃত্যুর খবরটি তার নানা জয়নাল ব্যাপারী প্রথম জানালে তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন। প্রতিবেশীরা দ্রুতই বাড়িতে ভিড় করতে শুরু করেন। তারা ফয়সালের মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। ফয়সালের মা ও স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে আশপাশের পরিবেশ।
বিজ্ঞাপন
ফয়সালের মা চায়না বেগম কান্নাজনিত কণ্ঠে বলেন, আমার ছেলের লগে দুই মাস আগে কথা হইছে। তখন ছেলে কইলো, ‘মা, টাকাপয়সা তো তেমন পাঠাতে পারতাছি না। তুমি কেমন আছো, আমি এখানে খুব ভালো আছি।’ আমি কইলাম, ‘বাবারে তুমি আইসা পড়ো। দেশেই কাম করো।’ বাবায় বলল, ‘মা, আমি চইলা আসব।’ কিন্তু আর তো ফিরা আইলো না। হায় আল্লাহ, তুমি আমার বাবারে আমার বুকে ফিরাইয়া দাও।
বিজ্ঞাপন
চায়না বেগম বলেন, ফয়সাল খালি কইত, মা, দেশে কাম নাই। আমি দুবাই যামু। পরে কীভাবে যেন ও নিজের মতো করে চলে গেল। পরে এক মাস কোনো খবর পাই নাই। কয়েক দিন পরে ফোন করে জানাইলো মা আমি দুবাই আছি। পরে মাসে একবার থেকে দুইবার কথা হইতো। আমরা কেউই জানতাম না যে ও পাকিস্তান গেছে।
ফয়সাল ঢাকার কালাচাঁদপুরে একটি স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছিলেন। বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় তিনি ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ওয়াজ মাহফিলে ভ্রাম্যমাণ দোকান বসিয়ে তসবি, জায়নামাজ, আতর ও টুপি বিক্রি করতেন বলে জানায় পরিবার।
ফয়সালের চাচা আবদুল হালিম বলেন, বাংলাদেশ থেকে দুই বছর আগে ফয়সাল নিজের মতো করে বিদেশ যাওয়ার কথা বলে কয়েক দিন নিখোঁজ ছিল। পরে ফয়সাল নিজেই ফোন করে জানায়, সে দুবাই গেছে। এরপরে আর কথা হয়নি। পরে গত কোরবানির ঈদের আগে আমার সঙ্গে ওর কথা হইছে। তারপরেই দুই মাস আগে মাদারীপুর শহর থেকে পুলিশ আমাদের বাড়িতে আসে। তারা জানায় ফয়সার দুবাই না, পাকিস্তান গেছে। তখন আমরাও চেষ্টা করেছি তাকে পাকিস্তান থেকে দেশে ফিরিয়া আনতে। কিন্তু আমরা চেষ্টা করেও পারি নাই।
নিহত ফয়সালের দাদা শুক্কুর মোড়ল বলেন, আমার দুই মেয়ে, ছয় ছেলে। ৯জন নাতি আমার। ফয়সাল সব নাতিপুতির মধ্যে সেরা ছিল। এক ওয়াক্ত নামাজও বাদ দিত না। নাতিটা খুব ভালো ছিল। এ পথে গিয়ে মারা গেছে, সেটা কল্পনাও করতে পারতাছি না। কারা আমার নাতিরে পাকিস্তান নিয়ে খারাপ পথে নিলো, তাদের যেন বিচার হয়।
ফয়সালের নানা জয়নাল ব্যাপারীও কোনোভাবেই মানতে পারছেন না নাতির মৃত্যুর কথা। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, এ ঘটনা শুনে আমরা সবাই অবাক। ফয়সাল পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত। মসজিদে সামনে টুপি–আতর বেচত। ধর্মীয় লাইনে ছিল। কীভাবে কী হয়ে গেল। হায় আল্লাহ, আর কারও যেন এমন দশা না হয়।
এ ব্যাপারে মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও অনুসন্ধান) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে মাদারীপুরের এক তরুণ মারা গেছে বলে আমরা জেনেছি। তার পরিবার যদি আমাদের কাছে আইনগত সহায়তা চায়, তাহলে পুলিশের পক্ষ থেকে আমরা সেটা অবশ্যই করব। পাকিস্তান থেকে নিহত তরুণের লাশ ফেরত আনার যদি কোনো ব্যবস্থা থাকে, সেটাও করা হবে। আর ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে তরুণ প্রজন্মকে ধর্মযুদ্ধে বা জঙ্গিবাদে যারা উৎসাহিত করছে, তাদের বিষয়ে পুলিশ কাজ করছে।