Thursday, September 11, 2025

ঘরে ঘরে হয় ওষুধের অপচয়

আরও পড়ুন

মানুষের জীবন রক্ষার অন্যতম প্রয়োজনীয় উপাদান ওষুধ। কিন্তু সচেতনতার অভাবে দেশের প্রতিটি ঘরে ওষুধের অপচয় হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের দাবি দেশে ওষুধের অপব্যবহার কিংবা অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারের পাশাপাশি অপচয়ও অনেক বেড়েছে। কিন্তু এখনও ওষুধের অপচয় রোধে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

মিরপুর ২ নাম্বার এলাকার বাসিন্দা সজীব আহমেদ। মা-বাবা ও বোনকে নিয়ে ৪ সদস্যের পরিবারে অসুস্থতা লেগেই থাকে। তাই নিয়মিতই ওষুধ কিনতে হয় তাকে। কিন্তু কষ্টের টাকা ব্যয় করে কেনা ওষুধের অনেকগুলোই অব্যবহৃত পরে থাকে। এভাবে গত ৬ মাসেই প্রায় ২ হাজার টাকা মূল্যের বিভিন্ন প্রকার ওষুধ জমে গেছে তার বাসায়।

সজীব বলেন, অনেক সময়ই দেখা যায় আমাদের বাসার কারো জ্বর, অ্যাসিডিটি বা পেট খারাপের মতো সমস্যা দেখা দিল। তখন চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ফার্মেসিতে গিয়ে নিজেরাই ওষুধ কিনে আনি। বেশিরভাগ সময় দেখা যায় কোনো সমস্যার জন্য একপাতা ওষুধ কিনলাম, কিন্তু ২-৪টি খাওয়ার পরই সমস্যা কেটে গেল। তখন বাকি ওষুধগুলো ড্রয়ারে বা যেখানে সেখানে পড়ে থাকে। এভাবে পরে থেকেই ওষুধের মোড়ক নষ্ট হয়ে যায়। তাই পরবর্তীতে আবারও অসুস্থ হলে আগের ওষুধগুলো আর খাওয়া হয় না। আবার নতুনকে ওষুধ কিনে আনি।

যাত্রাবাড়ীর ধোলাইপার এলাকার বাসিন্দা অনিক মৃধা জানান, ডাক্তারের প্রেসক্রিপসন অনুযায়ী ওষুধ কেনার পর বেশিরভাগ সময়ই কোর্স কমপ্লিট করা হয় না। দেখা গেল চিকিৎসক ৭ দিন ওষুধ খেতে বলেছেন, কিন্তু রোগী পঞ্চম দিনেই সুস্থ হয়ে গেছেন। তখন রোগীরা আর বাকি ওষুধগুলো খেতে চান না। যদিও এটা ঠিক না। তারপরও এমন হয়। এভাবেই অনেক ওষুধ বাসায় জমে যায়। আবার অনেকে নির্দিষ্ট সময় ওষুধ খেতে ভুলে যান, তাদের ওষুধগুলোও নষ্ট হয়।

ঢাকার সাভারের শ্যামলাসী এলাকার হাসান আলী বলেন, তিন শিশুসহ আমার পরিবারে ৫ জন সদস্য। প্রায়ই বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় তাদের জন্য ওষুধ কিনতে হয়। কিন্তু সেসব ওষুধের অনেকটায় আর ব্যবহার করা হয় না, বাড়িতেই পড়ে থাকে।

আরও পড়ুনঃ  গাজায় হঠাৎ হামলা সাময়িক বন্ধ রাখার ঘোষণা ইসরায়েলের

বড়দের চেয়ে ছোটদের ওষুধই বেশি অপচয় হয় দাবি করে তিনি বলেন, আমার বাড়িতে সবচেয়ে বেশি অপচয় হয় ছোটদের সিরাপ। তাদের জন্য কেনা বেশিরভাগ সিরাপের অর্ধেকই নষ্ট হয়। বড়দের জন্য ওষুধ কিনলে সেটা ভালোভাবে রাখলে কিছুদিন পর আবার ব্যবহার করা যায়। কিন্তু শিশুদের সিরাপ একবার খোলার পর সেটা আর পরবর্তীতে ব্যবহার করা যায় না। বাসার টেবিলের ওপর কিংবা ড্রয়ার খুললেই সেসব ওষুধ পাওয়া যায়। এভাবে দীর্ঘদিন পরে থাকার পর একসময় সেই ওষুধগুলোর ঠাঁই হয় ডাস্টবিনে।

মোহাম্মদপুরের বসিলার মদিনা ফার্মেসির মালিক সোলাইমান মিয়া বলেন, আমরা সাধারণত প্যারাসিটামল-গ্যাসট্রিকের মতো রোগের ওষুধ ফেরত নেই। কিন্তু ক্যান্সার, কার্ডিয়াকের মতো জটিল রোগের বিক্রিত ওষুধগুলো ফেরত নেওয়া হয় না। কারণ এসব ওষুধের দাম বেশি হয়, আবার বিক্রিও অনেক কম।

খিলগাঁওয়ের গোড়ান বাজার এলাকার ‘খিলগাঁও ড্রাগস’ ফার্মেসির মালিক মো. সিরাজ বলেন, আমার দোকান থেকে কেনা ওষুধ হলে আমি ফেরত নেই। তবে বিক্রিত ওষুধ ফেরত নিয়ে খুব একটা আসেন না কাস্টমাররা। শুধুমাত্র অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ নিয়ে মাঝেমধ্যে আসেন দু/একজন। সেসময় ওষুধের প্যাকেট নষ্ট না হলে ও মেয়াদ ঠিক থাকলে আমরা ফেরত নেই।

তিনি বলেন, তবে অন্য ফার্মেসি থেকে কেনা ওষুধ আমরা কখনো নেই না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, অনেক ওষুধ ভেজাল হয়। তাই আমরা কোনো ঝুঁকি নেই না।

যাত্রাবাড়ীর দনিয়া এলাকার শাহ আলম ড্রাগ হাউজের মালিক মো: শাহ আলম বলেন, সিরাপ, ইঞ্জেকশনসহ তরল ওষুধগুলো ফেরত নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ সেগুলোর বোতলের ক্যাপ খোলার নির্দিষ্ট সময় পরই সেগুলোর কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু ক্যাপসুল জাতীয় অব্যবহৃত ওষুধের মোড়ক ঠিক থাকলে ও মেয়াদ থাকলে ফেরত নেওয়া যায়। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই ওষুধ কিনে বাসায় নেওয়ার পর যেখানে সেখানে ফেলে রাখেন। ঠিকমতো সংরক্ষণ করেন না। এতে মোড়কটি নষ্ট হয়ে যায়।

আরও পড়ুনঃ  কক্সবাজারে লাইটার ট্রেনের ইঞ্জিন বগির ধাক্কায় অসহায় ১ কৃষকের মৃত্যু

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল ফার্মাসি এন্ড ফার্মাকোলজি বিভাগের একজন অধ্যাপক নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, দেশে কত কিছুর পরিসংখ্যান হয় গবেষণা হয়, অথচ ওষুধ অপচয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে নিয়ে কোনো পরিসংখ্যান কিংবা গবেষণা নেই। আর এই অপচয় রোধের কোনো উদ্যোগও নেই। অথচ সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করলেই এটি অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব। আমার মনে হয় দেশে এমন কোনো পরিবার নেই, যেখানে ওষুধের অপচয় হচ্ছে না।

তিনি বলেন, একজন চিকিৎসক রোগীকে বলে দেন কোন ওষুধ কতদিন ধরে কয়টি খেতে হবে। ওষুধ কেনার সময় সেই হিসেবে ওষুধ কিনে নিয়মমাফিক খেলেই কিন্তু কোনো অপচয় হয় না। অথচ বেশিরভাগ রোগীই চিকিৎসকের সেই পরামর্শ মানেন না। ধরেন কোনো ইনফেকশনের জন্য চিকিৎসক একটি ওষুধ ৭ দিন খেতে বলেছেন। রোগী ওষুধ কেনার সময় ৭ দিনেরই কেনেন। কিন্তু সেই ওষুধ ৩-৪দিন খাওয়ার পর যখন ইনফেকশন ভালোর দিকে যায় তখন রোগী ওষুধটি খাওয়া বাদ দিয়ে দেন। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কারণ এতে ওই ব্যক্তির শরীরে ওষুধের কার্যকারিতাও কমে যায়, না খাওয়া ওষুধগুলোও অপচয় হয়।

‘অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে ওষুধের মূল্য এখনও অনেক কম। কারণ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে এখনও আমরা ওষুধের পেটেন্ট বিনামূল্যে পেয়ে থাকি। কিন্তু কিছুদিন পরই আমরা উন্নয়নশীল দেশ হবো, তখন কিন্তু এই সুবিধা আর থাকবে না। তখন ওষুধের মূল্যও অনেক বেড়ে যাবে। সেজন্য এ বিষয়ে আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে।’ বলেন ঢাবির এই শিক্ষক।

তবে মানুষের অসচেতনতার পাশাপাশি ওষুধের অপচয়ের জন্য উৎপাদকদেরও দায়ী করলেন বাংলাদেশ কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সাবেক সিনিয়র সভাপতি আব্দুল হাই। তিনি বলেন, অব্যবহৃত ওষুধ ফেরত নিতে ফার্মেসি মালিকদের কারোরই কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু এসব ওষুধ যখন বিক্রি হবে না, মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে তখন সেগুলো উৎপাদকদের ফিরিয়ে নেওয়ার কথা। কিন্তু তারা সেই কথা রাখে না। প্রতিটি ফার্মেসিতে খোঁজ নিয়ে দেখেন অবিক্রিত ও মেয়াদ উত্তীর্ণ অনেক ওষুধ পরে আছে। এসব ওষুধেরই যখন কোনো গতি করতে পারছি না, তখন বিক্রিত ওষুধ ফেরত নিয়ে কী করবো আমরা? ফার্মেসিতে পড়ে থেকেও তো নষ্টই হবে সেগুলো।

আরও পড়ুনঃ  যেখানে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ দেখছেন সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ

তবে ওষুধের অপচয় বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সাধারণ মানুষের অসচেতনতার কারণেই ওষুধের অপচয় হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কারোরই কোনো ওষুধ খাওয়া ঠিক নয়। কিন্তু এরপরও অনেকেই তা করেন। আবার কেউ কেউ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার পর তা মনেন না। চিকিৎসক হয়তো ৭ দিন ওষুধ খেতে বলেছেন, কিন্তু রোগী খাচ্ছেন ৫ দিন। এটা কোনোভাবেই ঠিক নয়।’

তিনি বলেন, ‘ওষুধের বিষয়ে আমার আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, কিন্তু ওষুধের অপচয় রোধেতো কোনো আইন নেই। আর বিক্রিত ওষুধ ফেরত নেওয়ার জন্যও ফার্মেসি মালিকদের বাধ্যবাধকতা নেই। তাই এ বিষয়ে আমারা কিছু করতেও পারি না। আর ওষুধের অপচয় মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে কাজ করাও তো সম্ভব নয়। তবে আমরা বিভিন্ন সময় সচেতনতামূলক পোগ্রামের আয়োজন করি। সেখানে ওষুধের ব্যবহারসহ বিভিন্ন বিষয়ে মানুষকে সচেতন করা হয়। সাধারণ মানুষ সচেতন হলেই ওষুধের অপচয় রোধ করা সম্ভব। ’

দেশে ওষুধের অপচয় নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি জানিয়ে এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে ওষুধ ইচ্ছেমতো খাওয়ার জিনিস নয়। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়ম মেনে ওষুধ খেতে হবে। কিন্তু মানুষ সেটা না করে মুড়ি-মুড়কির মতো ওষুধ কিনে খাচ্ছে। অনেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যন্টিবায়োটিক ওষুধেরও কোর্স সম্পন্ন করে না। এতে শুধু ওষুধের অপচয়ই হচ্ছে না, নিজেদেরও অনেক ক্ষতি হচ্ছে। সেজন্য এ বিষয়ে আমাদের সবার সচেতন হওয়া খুবই জরুরি।’

আপনার মতামত লিখুনঃ

সর্বশেষ সংবাদ