এবারের প্রথম রমজানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) টিএসসিতে গণ-ইফতার কর্মসূচির আয়োজন করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হাত দিয়ে গড়ে উঠা শিক্ষার্থীদের নতুন রাজনৈতিক সংগঠন ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ’। পবিত্র রমজান মাসের প্রথম দিনেই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী বেশ উচ্ছ্বাসের সাথেই অংশ নেয় এই কর্মসূচিতে। তবে এক বছর আগেও তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এই গণ-ইফতার কর্মসূচি আয়োজন করা এতো সহজ ছিল না। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয় দেশের প্রায় সবকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও উল্লেখযোগ্য কলেজে গণ-ইফতার কর্মসূচি পালন নিয়ে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন শিক্ষার্থীরা।
ঘটনার সূত্রপাত গত বছরের মার্চ মাসে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেবার পবিত্র রমজান মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ইফতার পার্টির আয়োজন না করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে বিজ্ঞপ্তি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে এ বিশ্ববিদ্যালয়–সংশ্লিষ্ট সকলকে আসন্ন পবিত্র রমজান মাসে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে ইফতার পার্টির আয়োজন না করার জন্য অনুরোধ জানানো হলো।’ একইদিনে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. মুহাম্মদ আলমগীর সরকার স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে ইফতার পার্টি আয়োজন নিষেধাজ্ঞা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিজ্ঞপ্তি দুটো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে শুরু হয় তীব্র সমালোচনা। দেশের ধর্মপ্রাণ মুসল্লির পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা তুমুল সমালোচনা ও প্রতিবাদ জানান।
বিশ্ববিদ্যালয় দুটির ইফতার পার্টি না করতে এমন নির্দেশনা দেওয়ায় প্রতিবাদ জানায় বিভিন্ন মহল। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মুক্ত চর্চার প্রতিষ্ঠানের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে পরের প্রথম রোজাতেই (১২ মার্চ) গণ-ইফতারের ডাক দেয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সেদিন গণমাধ্যমের তথ্য মতে সেদিন একযোগে দেশের মোট ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘গণ-ইফতার’ কর্মসূচি পালন করে। প্রশাসন ও ক্ষমতাসীনদলের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ভয় ও শঙ্কার মধ্যে পালন করা শিক্ষার্থীদের সেই ‘গণ-ইফতার’ কর্মসূচি থেকেই আজকের প্রাণচঞ্চল ইফতার কর্মসূচি। এভাবেই শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক মহলে গণ-ইফতার কর্মসূচি জনপ্রিয় হয়ে উঠে ।
প্রতিবাদস্বরূপ ‘গণ-ইফতার’ কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে ছাত্রলীগের রোষানলে পড়তে হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। ক্ষমতাসীন দলের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছাত্রদের এমন কর্মসূচিতে বেপরোয়া হয়ে পড়ে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ। ‘গণ-ইফতার’ কর্মসূচির পর দিনই (১৩ মার্চ) প্রোডাক্টিভ রমাদান শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানে হামলা করে ছাত্রলীগ। এতে অন্তত ছয়জন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়। এখানেই ক্ষান্ত হয়নি তারা। ছাত্রলীগের আজ্ঞাবহ হিসেবে পরিচিত টিএসসিভিত্তিক ৬টি সংগঠন দ্বারা ‘গণ-ইফতার’ কর্মসূচির প্রতিবাদ জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি দেয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত। সংগঠনগুলো ১৬ মার্চ রাতে একসাথে নিজ নিজ প্যাডে হুবহু একই বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ জানায়।
বিবৃতিতে বলা হয়, সাম্প্রতিককালে একটি স্বার্থান্বেষী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ইফতারকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাসে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে নিষিদ্ধ ঘোষিত একটি সংগঠনের সদস্যরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে ধর্মের মোড়কে গণ-ইফতারের মতো অস্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মসূচি আয়োজন করছে। বিবৃতি দেওয়া সংগঠনগুলো হলো- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইটি সোসাইটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যান্ড সোসাইটি, স্লোগান’৭১, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কুইজ সোসাইটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফোকলোর সোসাইটি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্য সংসদ।
একইভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণ-ইফতার কর্মসূচির আয়োজন করা আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী জায়েদ এইচ জোহাকে বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে মারধর করেন নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের রাবি শাখার সভাপতি মোস্তাফিজুর বাবু ও সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল গালিব। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্টের মাধ্যমে সেদিনকার ঘটনা বর্ণনা করেছেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী জোহা।
ঘটনার বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘আমি গিয়ে গালিব আর বাবুর সামনে দাঁড়াতেই তারা আমাকে নিয়ে মুক্তমঞ্চের সিঁড়ির আড়ালে নিয়ে যায়। গিয়েই গালিব আমার কলার চেপে ধরে মুখে ঘুসি মারতে থাকে। এক পর্যায়ে বাবু পিস্তল বের করে আমার বুকে চেপে ধরে। হুট করে ঢুকে দুজন সাংবাদিক দেখেও ফেলে। কিন্তু তাদের কাছে ডকুমেন্টস না থাকায় এই কথা সামনে আনতে পারে না। সেখানে আমাকে বেশ কিছুক্ষণ হেনস্তা করে বুকে পিস্তল ধরে বলে তাদের শেখানো কথা মিডিয়াকে বলতে। এরপর আমি মিডিয়াকে সেটাই বলি যা তারা শিখিয়ে দেয়।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই ফেনী সরকারি কলেজে আয়োজিত গণ-ইফতার কর্মসূচিতে হামলা চালিয়ে পণ্ড করে দেয় ছাত্রলীগ। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে জানা যায়, গণ-ইফতারে অংশ নিতে শিক্ষার্থীরা বিকেল থেকেই কলেজের পাশের পাইলট স্কুল মসজিদে জড়ো হতে থাকেন। খবর পেয়ে জেলা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি তোফায়েল আহমেদ, কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি নোমান হাবিবসহ বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী সেখানে হাজির হন। নেতা-কর্মীরা শিক্ষার্থীদের সরে যেতে বলেন। একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হয়। পরে শিক্ষার্থীদের ব্যাট-স্ট্যাম্প দিয়ে বেধড়ক পিটায় ছাত্রলীগ। মারধর করে তাদের প্রায় আধা ঘণ্টা আটকে রাখা হয়। এরপর তাদের ফেনীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করানো হয়। এসময় ছাত্রলীগের হাতে মারধরে অন্তত আটজন আহত হয়।
বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হামলার পরেও গণ-ইফতার কর্মসূচি থেমে যায়নি। উল্টো হিড়িক পড়েছে এমন আয়োজনের। এখন গণ-ইফতার হয়ে উঠেছে বিশ্বাসের স্বাধীনতা ও প্রতিবাদের ভাষা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ফ্যাসিবাদী শাসনামলে ইফতার কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ার প্রতিবাদে এবারের প্রথম রমজানে ঢাবির ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) মাঠে গণ-ইফতার কর্মসূচি পালন করেছে নবগঠিত গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ। এতে হাজারখানেক শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছেন।
এসময় ইফতার পূর্ব সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক আবু বাকের মজুমদার বলেন, “গত বছর সাস্টে যখন ইফতারে বাধা দেয়, তখন আমরা পায়রা চত্বরে গণ-ইফতার করেছিলাম। এ বছর সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে গণ-ইফতারের আয়োজন করেছি। আজ আমাদের ধারণার চেয়েও বেশি শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছেন। আমরা সম্মিলিতভাবে ইফতার আনন্দ উপভোগ করব।”
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
রাবি প্রশাসনের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে আয়োজিত হয়েছে গণ-ইফতার। বিকেল থেকেই হাজার হাজার শিক্ষার্থীর ঢল নামে কেন্দ্রীয় মসজিদে। প্রশাসনের এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
বাকৃবি শাখা ছাত্রশিবিরের উদ্যোগের বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত দিনব্যাপী গণ-ইফতার কর্মসূচির আয়োজন করেছে। ইফতার কর্মসূচির প্রথম দিনে বাকৃবি শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে। সকল শ্রেণি পেশার মানুষ ও শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে উৎসবে পরিণত হয় মাহফিলটি।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বরে দ্বিতীয়বারের মতো গণ-ইফতারের আয়োজন করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শাবিপ্রবির স্টুডেন্ট এইড। এতে সহস্রাধিক শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। এতে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক অধ্যাপক এছাক মিয়া এবং সংগঠনটির উপদেষ্টা ড. মো. সেলিম। আলোচক হিসেবে ছিলেন শাবিপ্রবি কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম মাওলানা মতিউর রহমান।
ইফতার পূর্ব অনুষ্ঠানে স্টুডেন্ট এইড সাস্ট এর সভাপতি শাকিল মাহমুদ বলেন, “গত বছর শাবিপ্রবি প্রশাসনের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে আমরা গতবারের মতো এবারো গণ-ইফতারের আয়োজন করেছি। ইফতার আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতির অংশ। মুসলিমরা এ জনপদে যতদিন আছে, ততদিন ইফতারের আয়োজন হবে।”
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
নোবিপ্রবি শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে প্রথম রমজানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে আয়োজিত গণ-ইফতার কর্মসূচিতে বিভিন্ন হল ও বিভাগের শতাধিক শিক্ষার্থী স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন।
শিক্ষার্থীরা বলেন, স্বৈরাচারের দোসররা ক্যাম্পাসে গত বছর ইফতারের আয়োজনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল এবং অরাজকতা আখ্যা দিয়েছিল। এরই প্রতিবাদে গত বছরের প্রথম রমযানে নোবিপ্রবি ক্যাম্পাসে গণ-ইফতারের আয়োজন করা হয়েছিল। একই ধারাবাহিকতায় এ বছরের প্রথম রমযানে গণ-ইফতারের আয়োজন করা হয়েছে। এ আয়োজনে মুসলিম-অমুসলিম সবাই অংশগ্রহণ করতে পারবেন বলেও জানান তারা।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়
প্রথম রমজানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে প্রশাসনের উদ্যোগে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়ে দোয়া ও ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শওকত আলী।
তিনি বলেন, “রমজান মাসের প্রথম দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের সঙ্গে ইফতার করতে পেরে আনন্দ বোধ করছি। সবাই এক কাতারে বসতে পারাই আমাদের হৃদ্যতা। মহান আল্লাহ আমাদের রমজানকে কবুল করে নিক।”
এ সময় দোয়া ও ইফতার মাহফিল কমিটির আহ্বায়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মো. ফেরদৌস রহমান, রেজিস্ট্রার ড. মো. হারুন-অর রশিদ, ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. ইলিয়াছ প্রামানিক প্রমুখ। দোয়া মাহফিলটি পরিচালনা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের খতিব রকিব উদ্দিন আহাম্মেদ।