মাত্র মাসতিনেক আগেও যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে দু’দেশের নেতা-মন্ত্রী-কর্মকর্তারা অহরহ ‘সোনালি অধ্যায়’ বলে বর্ণনা করতেন– সেই ঢাকা ও দিল্লির পারস্পরিক কূটনীতিতে এই মুহূর্তে একটা চরম অস্বস্তিকর শীতলতার পর্ব চলছে বললেও আসলে বোধহয় কমই বলা হয়!
বাংলাদেশে নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নেয়ার পর ১০০ দিন শেষ, কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে আজ পর্যন্ত তার মুখোমুখি দেখাই হয়ে ওঠেনি। সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনের অবকাশে এরকম একটা বৈঠক আয়োজনের জন্য বাংলাদেশ অনুরোধও জানিয়েছিল, কিন্তু ভারত তা এড়িয়ে গিয়েছে।
দু’দেশের দুই বর্তমান নেতার মধ্যে এর মাঝে মাত্র একবারই টেলিফোনে কথা হয়েছে, কিন্তু ভারতের ভাষ্য অনুযায়ী সেখানেও প্রাধান্য পেয়েছে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের প্রসঙ্গ। সুতরাং সেই টেলিফোন আলাপেও ভারতের দিক থেকে স্পষ্টতই ছিল ‘নালিশ’ বা ‘অনুযোগে’র সুর।
অবশেষে শুরু হয়েছে।
ভারতের বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশে যে সব অবকাঠামো প্রকল্পে কাজ করছিল, তারও অনেকগুলোর কাজ জুলাই-অগাস্ট থেকে থমকে গেছে, আজ পর্যন্ত তা শুরু করা যায়নি। আদানি পাওয়ারসহ বিভিন্ন ভারতীয় সংস্থা বকেয়া অর্থ না-পেয়ে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহও কমিয়ে দিয়েছে
গত ১০০ দিনের ভেতর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশে বন্যার পানি ছাড়ার অভিযোগ বা দুর্গাপুজোর মণ্ডপে হামলা নিয়ে একাধিক প্রকাশ্য বিবৃতি জারি করতেও দ্বিধা করেননি– যাতে বাংলাদেশ সরকারের সমালোচনা ছিল স্পষ্ট!
এই ধরনের জিনিস কিন্তু বিগত ১৬-১৭ বছরে কখনওই দেখা যায়নি– যা থেকে পরিষ্কার বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে একটা ‘ওয়ার্কিং রিলেশনশিপ’ বা কেজো সম্পর্ক গড়ে তুলতেও দিল্লি রীতিমতো দ্বিধান্বিত।
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তথা ঢাকায় নিযুক্ত প্রাক্তন হাই কমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা অবশ্য এর মধ্যে বিশেষ অস্বাভাবিক কিছু দেখছেন না।
মালয়েশিয়া থেকে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘সম্পর্ক তো একেবারে থেমে নেই, চলছে। দু’পক্ষের মধ্যে কোনো অপ্রীতিকর আদানপ্রদান হয়নি, কেউ কাউকে আক্রমণাত্মক ভাষায় কথা বলেনি… এটাই কি যথেষ্ট নয়?’
“আসলে এটা তো বুঝতে হবে বাংলাদেশে যে সরকার ক্ষমতায় আছে তারা কোনো স্থায়ী সরকার নয়। তাদের ম্যান্ডেট কিছু থাকলেও সেটা খুব ‘লিমিটেড’- যে সে দেশে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা। তো এরকম একটা সরকারের সঙ্গে ভারতের নির্বাচিত সরকারের এনগেজমেন্টটাও লিমিটেড হওয়াটাই খুব স্বাভাবিক,” যোগ করেন শ্রিংলা।
তবে দু’দেশের সরকারের মধ্যে সম্পর্কের পরিধি সীমিত থাকলেও ‘পিপল টু পিপল’ কানেক্ট বা মানুষে-মানুষে সংযোগটা কিছুতেই বন্ধ করা উচিত নয় বলেই তার অভিমত
দিল্লি ও ঢাকার মধ্যে যা-ই চলুক, এটা যেভাবে হোক বজায় রাখতে হবে,’ বলছেন হর্ষবর্ধন শ্রিংলা।
অবশ্য গত ১০০ দিনে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক যে প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে– তা নিয়ে দিল্লিতে অন্তত পর্যবেক্ষকদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই, আর এর জন্য নির্দিষ্টভাবে কয়েকটি কারণকেও চিহ্নিত করছেন তারা।
এই প্রতিবেদনে এরকম তিনটি প্রধান কারণ ও তার পরিপ্রেক্ষিত ধরে ধরে বিশ্লেষণ করা হলো
হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের ইস্যু
বিগত ১০০ দিন ধরে ভারত একেবারে সর্বোচ্চ স্তর থেকে লাগাতার বাংলাদেশের কাছে যে বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ জানিয়ে এসেছে, তা হলো সে দেশে হিন্দুসহ সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও অত্যাচারের ইস্যু।
প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজে একাধিকবার মুহাম্মদ ইউনূসকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, সে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সম্পূর্ণ সুরক্ষা দেয়ার দায়িত্ব তার প্রশাসনের। শুধু তাই নয়, গ৩ ২৬ অগাস্ট যখন তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে টেলিফোনে কথা বলেন, তখনও বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের প্রসঙ্গটি তোলেন এবং কিছুক্ষণ বাদে বিরল এক পদক্ষেপে সে কথা টুইট করেও জানিয়ে দেন!
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও একের পর এক ব্রিফিং ও বিবৃতিতে বারবার বাংলাদেশ সরকারকে মনে করিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশে হিন্দুদেরও স্বাধীনভাবে ধর্মাচরণের অধিকার আছে এবং দুর্গাপুজোর সময় তাদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সে দেশের সরকারের।
কিন্তু ভারত সরকার ও ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির বিশ্বাস– এই গুরুতর বিষয়টিকে বাংলাদেশ সরকার হয় গুরুত্বই দিচ্ছে না, অথবা তারা পরিস্থিতি মোকাবেলায় চূড়ান্ত ব্যর্থ হচ্ছে!
তার যুক্তি ছিল, বাংলাদেশে হিন্দুরা মূলত আওয়ামী লীগ-সমর্থক এমন একটা ধারণা আছে– আর অভ্যুত্থানের পর যেহেতু শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সমর্থকদের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে, তাই হিন্দুদেরও কেউ কেউ এ ধরনের রাজনৈতিক হামলার শিকার হয়েছেন।
‘আমি কখনোই বলছি না যা ঘটেছে সেটা ঠিক হয়েছে, কেউ কেউ হয়তো আবার এটাকে (হিন্দুদের) সম্পত্তি দখলের অজুহাত হিসেবেও ব্যবহার করেছে’, এ কথাও যোগ করেছিলেন ড. ইউনূস।
এর প্রায় দু’মাস পর অতি সম্প্রতি বিবিসি হিন্দিকে দেয়া সাক্ষাতকারে বাংলাদেশের তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম আবার বলেছেন, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে সে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব তাদের সরকারের– এটা নিয়ে ভারতের বিচলিত বা উদ্বিগ্ন না হলেও চলবে!
অন্য দিকে সারা বিশ্বে নির্যাতিত হিন্দুদের সুরক্ষার ভার যে নরেন্দ্র মোদি সরকার নিজে থেকেই নিয়েছে বলে বারবার ঘোষণা করেছে– তাদের পক্ষে এই পরিস্থিতিতে নীরব থাকা সম্ভব নয় বলেই বিজেপি নেতারা যুক্তি দিচ্ছেন।
শুভ্রকমল দত্ত তো এমনও বলছেন, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর এই নির্যাতন অব্যাহত থাকলে ভারতের উচিত হবে ড. ইউনূসের সরকারের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা– যেমনটা করা হয়েছে আফগানিস্তানে তালেবান শাসকদের সাথেও!
ফলে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর হামলা বা অত্যাচারের আসল মাত্রা যতটাই হোক, বিষয়টা ঢাকা ও দিল্লির কূটনৈতিক সম্পর্কে ছায়াপাত করছে খুব গভীরভাবে।
পেয়ে গেছে বলে অনেক পর্যবেক্ষকই মনে করছেন, এবং একই কারণে ঢাকা ও দিল্লির সম্পর্কও তিক্ত থেকে তিক্ততর হচ্ছে।
কিন্তু দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতির স্বার্থে ভারত কি ভবিষ্যতে কখনো শেখ হাসিনাকে বিচারের জন্য বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়ার কথা বিবেচনা করতে পারে?
কোনো প্রশ্নই ওঠে না। প্রথম কথা, বাংলাদেশে তিনি সুষ্ঠু বিচার পাবেন তার কোনো নিশ্চয়তাই নেই। কেন ভারত তাকে একটা ক্যাঙ্গারু কোর্টের মুখে ঠেলে দিতে যাবে?’
‘দ্বিতীয়ত, আজ যদি ভারত শেখ হাসিনার সংকটের মুহূর্তে তার পাশ থেকে সরে দাঁড়ায় তাহলে আমাদের নেইবারহুডে কোনো দেশের কোনো নেতাই ভারতের বন্ধুত্বে আর কখনও ভরসা রাখতে পারবেন না,’ বিবিসিকে বলছিলেন ভারতের সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিবিদ টিসিএ রাঘবন।
ফলে ধরেই নেয়া যেতে পারে শেখ হাসিনা এখন লম্বা সময়ের জন্যই ভারতে থাকছেন– এবং যতদিন ধরে সেটা ঘটছে, ততদিন ঢাকা ও দিল্লির মধ্যেকার কূটনৈতিক সম্পর্কটা স্বাভাবিক হওয়াটা খুবই কঠিন!
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই প্রাক্তন রাষ্ট্রদূতের কথায়, ‘ড. ইউনূসকে বলব, আপনার সরকারের সাংবিধানিক ভিত্তি কী, সেটাই তো স্পষ্ট নয়! আর আদৌ যদি কোনো বৈধতা থেকে থাকে– সেটা ৯০ দিনের বেশি নয়, আর তাও শুধু নির্বাচন আয়োজনের জন্য!’
‘সেই জায়গায় আমরা কী দেখছি, ৯০ দিন কেটে গেছে আর আপনারা দেশ সংস্কারে নেমেছেন! ইন্টারভিউ দিয়ে বলছেন, তিস্তাসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টন হতে হবে সমতা আর ন্যায্যতার ভিত্তিতে।’
‘আরে বাবা, ভারত আপনাদের সাথে তিস্তা নিয়ে কথা বলতে যাবে কোন দুঃখে?’
‘বাংলাদেশের মানুষের ভোটে জিতে আপনারা ক্ষমতায় আসেননি, আপনাদের কোনো ম্যান্ডেটও নেই এটা নিয়ে কথা বলার,’ চাঁছাছোলা ভাষায় জানিয়ে দেন তিনি।
ঘটনা হলো, ভারতে যারা ক্ষমতার কেন্দ্রীয় বলয়ে আছেন এবং বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক কী হবে তার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করেন, তাদের অধিকাংশ কিন্তু এই যুক্তিতেই বিশ্বাস করেন।
তবে অন্তর্বর্তী সরকার সে দেশে দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করলে দিল্লির এই মনোভাবের পরিবর্তন হতে পারে, সেই ইঙ্গিতও কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে।
যতদিন না সেটা বাস্তবে ঘটছে, দিল্লি ও ঢাকার শীতল কূটনৈতিক সম্পর্কের বরফ গলবে সেই সম্ভাবনা সত্যিই আসলে খুব ক্ষীণ!