Thursday, April 10, 2025

নারীর প্রতি ক্রমবর্ধমান সহিংসতা

আরও পড়ুন

বিষয়টি শুধু উদ্বেগের কিংবা শঙ্কার অথবা ক্ষুব্ধতার নয়, বিষয়টি আতঙ্কের। নারীকে আক্রমণ এবং নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা সমাজে বেড়েই চলেছে। সে আক্রমণ এবং বিভিন্ন বলয়ে বিভিন্ন রূপে আত্মপ্রকাশ করছে। কোন কোন ক্ষেত্রে সেটা রূপ নিচ্ছে দেহজ এবং মানসিক নির্যাতনের, কোন কোন ক্ষেত্রে ধর্ষণসহ নানান যৌননিপীড়নের, কোন কোন ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ আক্রমণের।

এ বছরের জানুয়ারি মাসে ২০৫ জন নারী এবং কিশোরী নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা আছে ৬৭টি। পরের মাসে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে সারা দেশে ১৮৯টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ৪৮টি। বলা নিষ্প্রয়োজন যে, বাস্তব ঘটনা প্রদত্ত এসব উপাত্তের চেয়ে অনেক বেশি। অতি সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মচারী উত্যক্ত এবং নিপীড়ন করেছে এই বলে যে, কি জাতীয় পোশাক তাঁর পরা উচিৎ। আজ মেট্রোরেলের মধ্যে নারী যৌননিপীড়নের সংবাদ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এসেছে।

নারীর প্রতি পুরুষের ক্রমবর্ধমান সহিংসতা এবং বিদ্বেষ বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে পড়ার পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ- বিষাক্ত পুরুষতন্ত্র, চরম শ্রেষ্ঠবাদিতা, উগ্র মৌলবাদের বিস্তার, নারীবিদ্বেষী চর্চার বিস্তৃতি ইত্যাদি। এ রকমের বিদ্বেষের কারণেই পুরুষ নারীর স্বাধিকার কেড়ে নিতে চায়, তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, রোধ করতে চায় নারীকণ্ঠ, সীমিত করতে চায় তার নিজস্ব আত্মস্বত্ত্বা এবং আত্মপরিচয়।

প্রথমত: বিষাক্ত পুরুষতন্ত্র আত্মপ্রকাশ করে ক্ষমতা প্রদর্শন, ক্রোধ ও যৌনতার মাধ্যমে। নারী যেখানে মনোবলে বলীয়ান, পুরুষ সেখানে দেহবলে বলীয়ান। দেহবলে বলীয়ান পুরুষ তার পেশিশক্তি প্রতিনিয়তই ব্যবহার করে। দেহবলই পুরুষকে উন্মত্ত করে, যুক্তি-বিবর্জিত করে, সংঘাতপ্রবণ করে তোলে। এ পুরো দ্বন্দ্বে পুরুষ নারীকে তার ইচ্ছে পূরণের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে দেখে। অতএব এমন বাধাকে তো শৃঙ্খলিত করতেই হবে পুরুষকে। বিষাক্ত পুরুষতান্ত্রিকতা মানবকে দানবে পরিণত করে এবং পুরুষকে নারীবিদ্বেষী করে তোলে।

আরও পড়ুনঃ  হিজাব বাধ্যতামূলক নিয়ে কোনো বক্তব্য দেননি ঢাবির নতুন ভিসি

দ্বিতীয়ত: নারী বিষয়ে পুরুষের একটি চরম শ্রেষ্ঠবাদী ধারণা কাজ করে। পুরুষ মনে করে যে সে সর্ববিষয়ে নারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠতর এবং তার অসাধ্য কিছু নেই। অন্যদিকে নারী জানে, কোথায় তার শক্তি, কোথায় তার দুর্বলতা। নারীর দুর্বলতা পুরুষের পরিহাসের বিষয়, আর তার শক্তি পুরুষের অস্বস্তির কারণ। জীবনধারায় নারী পুরুষকে পরিপূরক হিসেবে দেখে, কিন্তু পুরুষ নারীকে দেখে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে। সুতরাং সম্পূরক হতে পুরুষের প্রবল আপত্তি।

এই উগ্র শ্রেষ্ঠবাদী মনোভাবের কারণে পুরুষ নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ হিসেবে গণ্য করে, তাঁর বুদ্ধি-বিবেচনা নিয়ে পরিহাস করে, তাঁর মনন ও চিন্তাকে খাটো করে। নারীর বাস্তববাদিতা ও যুক্তিনির্ভরতা অযৌক্তিক পুরুষকে ক্ষিপ্ত করে এবং তখন সে নারীকে বন্দী করার জন্যে ব্রতী হয়। একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে দেখা হয় পুরুষের একটি ভোগ্যপণ্য হিসেবে। ভোগের পণ্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয় তার মালিকানা নিশ্চিত করতে হলে, তাকে শাসনে রাখতে হয় অবাধ্যতা নির্মূল করার জন্যে, তাকে আটকে রাখতে হয়, যখন খুশী তখন ভোগ করার জন্যে।

আরও পড়ুনঃ  ফরিদপুরে ২ ভাইকে পিটিয়ে হত্যা: তপন ও অজিতকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা

তৃতীয়ত: বলার অপেক্ষা রাখে না যে নারীর প্রেক্ষিতে উগ্র মৌলবাদী চিন্তা-চেতনা নারীকে নিয়ন্ত্রণ করাকে সঠিক বলে মনে করে, নারীর ওপরে পুরুষের কর্তৃত্বকে অনুমোদন করে এবং পুরুষকে নারীর ক্ষেত্রে ‘নৈতিক পুলিশের’ দায়িত্ব দেয়। আমাদের সমাজে এ জাতীয় উগ্র মৌলবাদী চিন্তা-চেতনা যত বিস্তার লাভ করবে, বিশেষত: পুরুষের মাঝে, ততই নারীর ওপরে পুরুষের কর্তৃত্ববাদ, নিপীড়ন, নারীর স্বাধিকারের ওপরে পুরুষের হস্তক্ষেপ বেড়ে যাবে। তখন পুরুষ বলে দেবে কি পোশাক পরিধান করা নারীর উচিত, কোথায় কোথায় নারী যেত পারবে, কি কি করার অনুমতি তার আছে। সেগুলোর কোন লঙ্ঘন হলে যে কোন পুরুষ, শুধুমাত্র পুরুষের অধিকার বলে, সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারবে, নারীকে নিপীড়ন করতে পারবে, তাকে শাস্তি দিতে পারবে। নারীবিদ্বেষী চর্চার বিস্তৃতি এই উগ্র শ্রেষ্ঠত্ববাদকে আরও পাকাপোক্ত করেছে।

বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে, বৈশ্বিক প্রেক্ষিতেও নারীর অধিকার ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে। এ দুর্বলতার পেছনে রয়েছে বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পিছিয়ে পড়া, নানান গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা, নারী অধিকার বিষয়ে দীর্ঘদিনের অর্জিত নানান ঐক্যমতকে ক্ষুণ্ন করার ক্ষেত্রে নারী অধিকার বিরোধীদের সাফল্য ইত্যাদি। এর ফলে সংঘাত-সম্পৃক্ত যৌন সহিংসতা গত ১৯ বছরে ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে, যার ৮৫ ভাগই শিশু বা তরুনী। অন্তত: ১২টি দেশে ৫৩ শতাংশ নারী আন্তর্যোগ বা অন্যান্য মাধ্যমে সহিংসতার শিকার হয়েছেন। বিশ্বব্যাপী নারী ও মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা উদ্বেগজনক ভাবে বেড়ে গেছে।

আরও পড়ুনঃ  হাতজোড় করে যা চাইলেন পলক

কিন্তু বাংলাদেশের জন্যে নারীর প্রতি বিদ্বেষ সহিংসতা হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি আতঙ্কজনক পরিস্থিতি। বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা একটি নিয়মে পরিণত হয়েছে, এটা যেন আর ব্যতিক্রম নয়। সেই সঙ্গে এ সহিংসতা একটি ‘মব’ সহিংসতায় রূপান্তরিত হয়েছে। একটি গোষ্ঠী পরিস্থিতি তৈরি করে ‘মব’ সহিংসতা তৈরি করছে। এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে দায় স্বীকার করে শক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য সব সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে শক্ত হাতে। নারী বিদ্বেষী চর্চাকে প্রতিহত করতে হবে যূথবদ্ধভাবে ও সামাজিকভাবে। প্রতিবাদ এবং প্রতিকার করতে হবে সবাই মিলে।

আজকের বাংলাদেশে নারীর প্রতি যে সহিংসতা ঘটেছে, সেটা শুধু নারীর প্রতি সহিংসতা নয়, সেটা মানবতার বিরুদ্ধে সহিংসতা, স্বাধিকতার বিরুদ্ধে বিদ্বেষ, শুভ বুদ্ধির প্রতি হুমকি। এ লড়াই আমাদের সবার এবং এ লড়াই লড়ার কোনো বিকল্প নেই। চূড়ান্ত বিচারে এ লড়াইয়ে দেশকে জিততে হবে।

ড. সেলিম জাহান: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]

আপনার মতামত লিখুনঃ

সর্বশেষ সংবাদ