Tuesday, December 24, 2024

৪৩ বিলি*য়নের চাপে দেশ

আরও পড়ুন

বড় বড় প্রকল্পের নামে ঢালাওভাবে গৃহীত বিদেশি ঋণ সরকারের জন্য বড় ধরনের ফাঁদ তৈরি করেছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের পর দেখা যাচ্ছে, সেগুলো থেকে প্রাপ্ত সুফল আর্থিক দায়ের তুলনায় নগণ্য; উপরন্তু কর্ণফুলী টানেলের মতো কিছু প্রকল্প এখন সরকারের গলার ফাঁস হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের পরপরই শুরু হয়েছে সুদাসলে কিস্তি পরিশোধের চাপ। কিন্তু অর্থনীতিতে সুফল মিলছে না। বাংলাদেশ প্রতিদিনের করা প্রতিবেদন থেকে বিস্তারিত-

এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে দেশের ২০টি বড় প্রকল্পের বিপরীতে বিদেশি ঋণ নেওয়া হয়েছে প্রায় ৪৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এখন পরবর্তী সরকারের কাঁধে এ ঋণ পরিশোধের বোঝা চেপেছে।

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আর্থিক অনিয়ম নিয়ে প্রণীত অন্তর্বর্তী সরকারের শ্বেতপত্রের তথ্য বলছে, বর্তমানে বিদেশি ঋণের সুদাসল বাবদ যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে ২০২৮ সালে গিয়ে তার তিন গুণ বেশি দায় পরিশোধ করতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে, পতিত সরকারের আমলে ঢালাওভাবে গৃহীত বিদেশি ঋণের দায় পড়বে নির্বাচিত সরকারের ঘাড়ে।

শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, বিভিন্ন প্রকল্প ও বাজেট সহায়তার বিপরীতে সরকারের গৃহীত বিদেশি ঋণের সুদাসল বাবদ ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ২ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করার লক্ষ্য রয়েছে। রাজস্ব আহরণ ও রেমিট্যান্স আয়ের সীমাবদ্ধতা এ চাপ আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা করে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, বড় প্রকল্পের বিপরীতে গৃহীত বিদেশি ঋণ পরিশোধের দায় রাষ্ট্রের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করেছে।

আরও পড়ুনঃ  এক কেজি খেজুরে ৫৩০ টাকা লাভ!

কত দায় কত পরিশোধ : নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের করা ‘বাংলাদেশের বৃহৎ ২০টি মেগা প্রকল্প : প্রবণতা ও পরিস্থিতি’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গৃহীত ২০ মেগা প্রকল্পে যে ৪৩ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ নেওয়া হয়েছে তার সবচেয়ে বড় অংশ ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ দিতে হবে রাশিয়াকে, জাপানকে দিতে হবে ৩৫ শতাংশ এবং চীনকে প্রায় ২১ শতাংশ অর্থ পরিশোধ দিতে হবে।

এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা ও অন্যান্য সংস্থার ঋণ রয়েছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বিদেশি ঋণের বকেয়ার যে তথ্য দিয়েছে, তাতে দেখা যায় বাংলাদেশের কাছে ৬২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার পাওনা রয়েছে দাতা সংস্থাগুলোর। এর বিপরীতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে হয়েছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আরও ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশি ঋণের দায় পরিশোধ করতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘কিছু প্রকল্পের বিপরীতে যাচাইবাছাই ছাড়াই বিদেশি ঋণ নেওয়া হয়েছে। এসব ঋণের কতটা ব্যবহার হয়েছে আর কতটা পাচার হয়ে গেছে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বিদেশি ঋণগুলো যদি সঠিকভাবে ব্যবহার হতো তবে অর্থনীতিতে এর সুফল পাওয়া যেত। কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে দেখা যাচ্ছে সেগুলো কোনো কাজেই আসছে না।’

আরও পড়ুনঃ  ১০ ব্যাংক ‘ভেতরে ভেতরে দেউলিয়ার দ্বারপ্রান্তে’: শ্বেতপত্র

তিনি জানান, খুলনার খালিশপুরে স্থাপন করা হচ্ছে রূপসা ৮০০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এ প্রকল্পে ৫০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। কাজ শেষের পথে। এখন দেখা যাচ্ছে, গ্যাস সংকটের কারণে এটি বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারছে না। ফলে এ প্রকল্পে বিদেশি ঋণের সুফল নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।’

বিশ্বব্যাংকের সাবেক এ লিড ইকোনমিস্ট বলেন, ‘প্রকল্পগুলোর বিপরীতে যারা ঋণ নিয়েছেন তাদের যেমন দায় ছিল, তেমন দায় ছিল যারা ঋণ দিয়েছেন তাদেরও। ঋণদাতা সংস্থাগুলো যদি সঠিকভাবে যাচাইবাছাই করে ঋণ দিতেন তবে বিদেশি ঋণের দায় পরিশোধের বোঝা এত বেশি হতো না। এখন জনগণের করের টাকায় এ দায় পরিশোধ করতে হবে, যে টাকা পাচার হয়ে গেছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৈদেশিক ঋণের চাপ সৃষ্টির পেছনে রয়েছে রাশিয়া, জাপান ও চীনের কয়েকটি মেগা প্রকল্প। পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পের জন্য চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ২ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি হয় ২০১৮ সালে। গত বছরের এপ্রিলে এ প্রকল্পের পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়েছে। ফলে চলতি অর্থবছর থেকেই ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ পড়েছে সরকারের ঘারে। ১৫ বছর ধরে এ ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। ডিপিডিসি প্রকল্পের আওতায় পাওয়ার সিস্টেম নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণের জন্য ২০১৯ সালে চীনের কাছ থেকে ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয় সরকার। এ ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়েছে গত জুনে। ফলে জুলাইয়ে শুরু হয়েছে কিস্তি পরিশোধের চাপ। এ ছাড়া কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের জন্য নেওয়া চায়নিজ ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছে প্রকল্পটি উদ্বোধনের আগেই। প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটিতে চীন ও বাংলাদেশ যৌথভাবে অর্থায়ন করেছে। ২ শতাংশ সুদে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে বেইজিং।

আরও পড়ুনঃ  বাংলাদেশি পর্যটকের সংখ্যা কমে অর্ধেক, কলকাতার ব্যবসা খাতে বড় ধাক্কা

গ্রেস পিরিয়ড শেষ হওয়ায় ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকেই এ প্রকল্পের কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে সরকারকে। চীনের এসব প্রকল্প ছাড়াও কিস্তি পরিশোধে চোখ রাঙাচ্ছে রাশিয়ার অর্থায়নে নির্মিতব্য রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এর বাইরে ঢাকা মাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট মেট্রোরেল লাইন-১, মাতারবাড়ী ১২০০ মেগাওয়াট কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকা মাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট মেট্রোরেল লাইন-৫, মতিঝিল-উত্তরা মেট্রোরেল লাইন-৬, ফোর্থ প্রাইমারি এডুকেশন ডেভেলমেন্ট প্রোগ্রাম, শাহজালাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট প্রশস্তকরণ প্রকল্প, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ যমুনা নদীতে রেলওয়ে ব্রিজ প্রকল্পের মতো বড় প্রকল্প রয়েছে; যেগুলোর বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ প্রতি বছরই যুক্ত হবে।

আপনার মতামত লিখুনঃ

সর্বশেষ সংবাদ