দেশে শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি। তবে শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, আগামীতে সপ্তাহের প্রতি শনিবার স্কুল খোলা রাখার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। তবে এর বিরোধিতা করে প্রয়োজনে আন্দোলনে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে শিক্ষক মহল।
চলতি বছর রমজানের কয়েকদিন আগে রোজায় স্কুল খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে এর বিরোধিতা করেছিলেন কেউ কেউ। শেষ পর্যন্ত বিষয়টা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। অ্যাডভোকেট ইলিয়াস আলী মন্ডল নামে একজন আইনজীবীর রিটে প্রথমে হাইকোর্ট স্কুল খোলা রাখার সিদ্ধান্ত স্থগিত করেন, পরে রোজা শুরুর প্রথম দিন ১২ মার্চ আপিল বিভাগ হাইকোর্টের সেই আদেশ স্থগিত করে স্কুল খোলা রাখার সিদ্ধান্ত দেয়। রমজানের সময় ১৫ দিন সরকারি-বেসরকারি নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণি কার্যক্রম চালু রাখার কথা বলা হয়। অন্যদিকে, রমজানের প্রথম ১০ দিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম চালু রাখার কথা বলা হয়। আগের বছর অবশ্য রমজানে স্কুল বন্ধ ছিল।
২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, ‘রমজানে স্কুল খোলা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রচার-অপপ্রচার হয়েছে। যেহেতু এই বছর বিষয়টি এসেছে, আমরা আগামীতে চেষ্টা করবে, কীভাবে এটি কাঠামোর মধ্যে আনা যায়। বছরে ৫২টি শনিবার রয়েছে, সেখানে কিছুটা খোলা রেখে রমজানের ক্ষেত্রে যে বিতর্ক হচ্ছে, বিতর্ক সৃষ্টির অপপ্রয়াস যারা করছে, সেটি আমরা বন্ধ করতে পারি।’
আন্দোলনের হুমকি
শিক্ষামন্ত্রীর এই পরিকল্পনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন শিক্ষক নেতারা। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যক্ষ মো. সেলিম ভুঁইয়া বলেন, ‘শনিবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার কোনো রকম সিদ্ধান্ত আমরা মনব না। আমরা আন্দোলনের কর্মসূচি দেবো। শিক্ষকরা এর বিরুদ্ধে মাঠে নামবে।’
সেলিম ভুঁইয়া বলেন, ‘অনির্বাচিত সরকারের শিক্ষামন্ত্রী হওয়ায়ই তিনি ওই কথা বলতে পেরেছেন। সরকারি ছুটি শুক্র, শনি দুই দিন। আর উনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শনিবার খোলা রাখবেন। তার বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি। দেশে ছয় লাখ শিক্ষক ও তাদের পরিবার এবং ছাত্র ও অভিভাবকরা শনিবার স্কুল খোলা থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এক দেশে তো দুই আইন চলতে পারে না।’
আর প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামসুদ্দিন মাসুদ বলেন, ‘সপ্তাহে দুই দিন ছুটি, এটা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত। প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত। শিক্ষামন্ত্রীর কথায় শনিবার ছুটি বাতিল হতে পারে না। আমরা এটা মানব না। আমার মনে হয়, শিক্ষামন্ত্রী তার নিজের চিন্তার কথা বলেছেন।’
শিক্ষার মান এবং শিক্ষার্থীদের কথা কেউ ভাবছেন কিনা, এমন প্রশ্ন তুলেছেন অভিভাবকরা। মিরপুরে থাকেন জেসমিন লিপি। তার সন্তান চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। তিনি বলেন, ‘এবার তো আমরা প্রচণ্ড মানাসিক চাপে ছিলাম। কী হবে বুঝতে পারছিলাম না। প্রথম রোজায়ও জানতাম না স্কুল খোলা না বন্ধ। এভাবে তো হতে পারে না। আসলে শিক্ষা নিয়ে কেউ ভাবে বলে মনে হয় না।’
জেসমিন লিপি বলেন, ‘এখন শুনছি শনিবারে স্কুল খোলা থাকবে। এটা কোন বিবেচনায়? আমি কর্মজীবী নারী। ছুটির দিনে আমার অনেক ব্যক্তিগত কাজ থাকে। আর সবাই দুই দিন ছুটিতে অভ্যস্ত। সব বন্ধ থাকবে, স্কুল খোলা থাকবে; এটা কী রকম হয়?’
আরেক অভিভাবক শাকিল আহমেদ বলেন, ‘আসলে রমজানে স্কুল বন্ধ থাকার প্রশ্ন উঠেছে ঢাকার তীব্র যানজটের কারণে। রমজানে যানজট বেড়ে যায়। আমরা তো রমজানে ক্লাস করেছি, পরীক্ষা দিয়েছি। এখনো তো কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকে। আমরা মনে হয় কেউ কেউ ধর্মীয় আবেগে কথা বলছেন।’
‘আবার শনিবার স্কুল খোলা রাখলে তা হবে আরেকটি ভুল সিদ্ধান্ত। কারণ, দেশ এক নিয়মে চলে, স্কুল আরেক নিয়মে চলবে তা তো হয় না’, বলেন শাকিল আহমেদ।
আর বাংলাদেশ অভিভাবক ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, ‘শনিবার ছুটি বাতিল করা হলে সবারই একটা ছুটির প্ল্যান থাকে। শনিবার স্কুল খোলা থাকলে অভিভাবকরা ওই ছুটির দিন কোনো কাজে লাগাতে পারবেন না।’
এক প্রশ্নের জবাবে জিয়াউল কবির বলেন, ‘রমজানে যারা স্কুল বন্ধ রাখার দাবি তুলেছেন তাদের ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকতে পারে, কিন্তু এর জন্য দায়ী শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কারণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য সারা বছরের ক্যালেন্ডার থাকবে। সেইভাবে স্কুল খোলা ও বন্ধ থাকবে। এখানে রমজান বিষয় না। আলদা কেন সিদ্ধান্ত হবে?’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, ‘ক্যালেন্ডারের ভিত্তিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলবে। কখন বন্ধ, কখন খোলা, কখন পরীক্ষা তার ক্যালেন্ডার তো আগেই তৈরি হয়ে যাবে। হঠাৎ করে বছরের মাঝখানে বন্ধ, খোলার বিতর্ক আসবে কেন? এটা শিক্ষা নিয়ে পরিকল্পনাহীনতার কারণে হয়।’
মজিবুর রহমান বলেন, ‘শনিবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার পরিকল্পনা নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী কি স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলেছেন? এরকম একটি কথা বলে তিনি একটা অস্থিরতা তৈরি করেছেন। আর রমজান শুরুর আগে কেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রজ্ঞাপন দিতে হবে। এটা তো আগে থেকেই অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডারে থাকবে। আর এই সুযোগে ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ। আর অভিভাবক ও ছাত্ররা ছিল মানসিক চাপে।’
শিক্ষাবিদ অ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘আসলে শিক্ষা নিয়ে এখানে সঠিক কোনো পরিকল্পনা নেই। সুদূরপ্রসারী কোনো চিন্তা নেই। কেউ শিক্ষা নিয়ে ভাবে বলে মনে হয় না। সেটা ভাবলে ছুটি নিয়ে এতটা সংকট তৈরি হয় না। সব চলছে অ্যাডহক ভিত্তিতে। তাই যখন যেটা মনে আসে সেটা বলে।’