Monday, December 23, 2024

তোফাজ্জলকে হত্যার আগে পরিবারের কাছে চাওয়া হয় ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা

আরও পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জলকে (৩২) পিটিয়ে হত্যার আগে তার পরিবারের কাছে ফোন করে ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা দাবি করা হয়েছিল।

নিহত তোফাজ্জলের বড় ভাইয়ের স্ত্রী শরীফা আক্তার বিষয়টি ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, তোফাজ্জলকে আটকে রেখে আমার কাছে ২ লাখ ও আমরা মামা শ্বশুরের কাছে ৩৫ হাজার টাকা দাবি করা হয়।

মোবাইল ফোন চুরির অপবাদে পিটুনিতে নিহত তোফাজ্জল বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাঠালতলী ইউনিয়নের তালুকের চরদুয়ানী নামক এলাকার মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে। এছাড়া তিনি ওই ইউনিয়নের সাবেক ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। তোফাজ্জল বরিশাল বিএম কলেজ থেকে বাংলায় অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেছেন।

এদিকে মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জলকে মোবাইল চুরির অপবাদ দিয়ে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে পাথারঘাটার চরদোয়ানি এলাকায়। স্থানীয় বাসিন্দাসহ সহপাঠী ও বন্ধুরা বলছেন, তোফাজ্জল মানসিক ভারসাম্যহীন হলেও কখনও কারও ক্ষতি করেননি। এছাড়া তাকে আটকে রেখে স্বজনদের কাছে টাকা দাবি করায় বিষয়টি নিয়ে এলাকা জুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।

তোফাজ্জলকে পিটিয়ে হত্যার আগে পরিবারের কাছে টাকা দাবির বিষয়ে জানতে সরেজমিনে তার ভাইয়ের স্ত্রীর বাড়িতে গেলে শরীফা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) আনুমানিক রাত ১০টার পরে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে তোফাজ্জল আমাকে ফোন করেন। এ সময় তিনি বলেন, ভাবি আমাকে মোবাইল চুরির দায়ে হলে আটকে রেখে আমার কাছে টাকা চায়। এ কথা বলার পরেই ফোন কেটে দেয়।

আরও পড়ুনঃ  রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক শেষে যা বললেন সমন্বয়করা

পরবর্তীতে ওই নাম্বার থেকে আবার কল দিয়ে আমার কাছে জানতে চাওয়া হয়, আমি তোফাজ্জলের কে হই। পরিচয় বলার পরে তারা আমাকে বলেন, তোফাজ্জলকে মোবাইল চুরির দায়ে আটকে রেখেছি ওকে আপনারা ছাড়িয়ে নিয়ে যান। এ সময় আমি তাদের বলি, ভাই ওর মাথায় সমস্যা আছে, ও আসলে চোর না। তোফাজ্জল একজন ভালো ছাত্র, অনার্স- মাস্টার্স শেষ করা ছাত্র, ওকে আপনারা ছেড়ে দিন। পরে তারা আমাকে বলেন, আপনার কথা রেকর্ড করা হচ্ছে। আপনি দুই লাখ টাকা পাঠান, না হলে তোফাজ্জেলকে আমরা মেরে ফেলবো। তখন তাদের আমি বলি, আমি মহিলা মানুষ, কীভাবে কি করব? আমি তো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারব না। পরে তোফাজ্জলের মামা-চাচা যারা ঢাকায় আছেন তাদের মোবাইল নম্বর দিয়ে দেই।

তিনি আরও বলেন, আমার কাছে টাকা দাবি করলে আমার অভিভাবক যারা আছেন তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলি। এ সময় তারা ফোনে আমাকে বলেন, অভিভাবকরা যদি ফোন না ধরে তাহলে কিন্তু খবর আছে। পরে আমি আতঙ্কিত হয়ে চাচাতো ভাশুর এবং এলাকার চৌকিদারকে বিষয়টি জানালে তারা বলেন, তোফাজ্জল হয়ত কোনো পাগলামি করেছে, আপনি ফোন বন্ধ করে ঘুমান। এছাড়া তারা তোফাজ্জলের এক মামার কাছে ফোন দিয়ে আরও ৩৫ হাজার টাকা দাবি করা হয়। এরপর সকালে ঘুম থেকে উঠে মোবাইল খুললে খবর পাই তোফাজ্জলকে মেরে ফেলা হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  প্রত্যেককেই আমি শিক্ষা দিয়ে ছাড়বো আর আমি যেটা বলি আমি করি

খোঁজ নিয়ে নিহত তোফাজ্জলের স্বজন সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর অপবাদে গণপিটুনিতে নিহত তোফাজ্জল আগে থেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। ২০১১ সালে বাবা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ও ২০১৪ সালে তার মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বড় ভাই নাসির উদ্দিনের বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করেছেন। পরবর্তীতে ২০২০ সালের পর থেকেই তোফাজ্জল মানসিকভাবে অসুস্থ হতে শুরু করেন। এ সময় তাকে ৩ মাস রিহ্যাবেও রাখা হয়েছিল। এরপর তোফাজ্জল কিছুটা সুস্থ হলে ২০২৩ সালে তার বড় ভাই নাসির উদ্দিনও ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। অভিভাবকহীন হয়ে পড়েন তিনি। এতে তোফাজ্জল আবারও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বিভিন্ন ধরনের অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করেন।

আরও পড়ুনঃ  ফরিদপুরের নগরকান্দায় নকল খেজুরের গুড়ের কারখানায় ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান, জরিমানা

তোফাজ্জলের প্রতিবেশী মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, তোফাজ্জল আমার ছোট ভাইয়ের মতো ছিল। যখন এলাকায় ওদের বাসা ছিল, তখন তাদের বাসায় গিয়ে থেকেছি, খেয়েছি। ওর বড় ভাই নাসিরের সঙ্গে আমরা চলাফেরা করেছি। এলাকার কেউ বলতে পারবে না তোফাজ্জল খারাপ ছেলে ছিল। তিনি কখনও করো কোনো ক্ষতি করেননি। বাবা-মা ও ভাইকে হারিয়ে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। বিশেষ করে তোফাজ্জলের যখন খুদা লাগতো তখন বেশি হতভম্ব হয়ে যেতেন তিনি। আত্মীয়-স্বজন বা পাড়া প্রতিবেশী যারা আছেন, তাদের থেকে টাকা চেয়ে নিয়ে খেতেন। কিন্তু কারো কোনো ক্ষতি করতেন না। যারা তাকে মর্মান্তিকভাবে হত্যা করেছে, আমরা তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।

উল্লেখ্য, বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে তোফাজ্জলকে আটকে রাখেন শিক্ষার্থীরা। সেখানে কয়েক দফায় তাকে মারধর করা হয়। পরে পুলিশের মাধ্যমে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তোফাজ্জলকে মৃত ঘোষণা করেন।

আপনার মতামত লিখুনঃ

সর্বশেষ সংবাদ