জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রান্তিক গেট সংলগ্ন একটি দোকানে বুধবার বিকেলে অবস্থান করছিলেন শামীম মোল্লা। সেই খবর পেয়ে একদল শিক্ষার্থী সেখানে তাকে গণপিটুনি দেয়। খবর পেয়ে সেখানে পৌঁছায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম।
সেখান থেকে নিরাপত্তা কর্মীদের সহায়তায় তাকে নেওয়া হয় নিরাপত্তা কার্যালয়ে। সেই কার্যালয়ের গেটের তালা ভেঙে ফের তার ওপর হামলা চালানো হয়। এতে গুরুতর আহত হন তিনি। পরে পুলিশের গাড়িতে তোলার সময় তৃতীয় দফায় তার ওপর হামলা হয়। এরপর হাসপাতালে নেওয়ার পথে মৃত্যু হয় শামীমের।
নিহত শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লা গণি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯ ব্যাচের ইতিহাস বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগের জুয়েল-চঞ্চল কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক।
শামীমকে হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে জাবি। ওই ঘটনাকে বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ড আখ্যা দিয়ে দ্রুত এর বিচারের দাবিতে বিক্ষোভসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল বৃহস্পতিবার সারা দিন ক্যাম্পাসে এমন চিত্র দেখা গেছে।
জানা যায়, বুধবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর আটক করে গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক শামীমকে মৃত ঘোষণা করেন। আশুলিয়া থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিকি বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিস থেকে আমাদের অবহিত করলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করি। এরপর গাড়িতে তুলে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত্যু ঘোষণা করেন। ধারণা করছি, হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে।
ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নিরাপত্তা কার্যালয়ের ভেতরে জিন্স প্যান্ট ও শার্ট পরিহিত এক ব্যক্তি শামীমকে মারধর করছে। কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে ওই ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৩ ব্যাচের সাবেক শিক্ষার্থী ও ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ ভূঁইয়া বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
চেক শার্ট পরিহিত আরেক ব্যক্তি গাছের ডাল দিয়ে শামীমকে পেটাতে দেখা যায়। তিনি ৪৫ ব্যাচের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী রাজু হাসান। এ ছাড়া মারধরে অংশ নেওয়া লাল হাফশার্ট পরা আরেক ব্যক্তি হলেন একই বিভাগের ৪৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী রাজন হাসান। সর্বশেষ পুলিশের গাড়িতে তোলার সময় শামীমকে মারধর করেন ইংরেজি বিভাগের ৪৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী হামিদুল্লাহ সালমান।
এ ছাড়া কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী এম এম সোহাগকে লাঠি হাতে মারধর ও উসকানি দিতে দেখা যায়। অভিযুক্তরা সবাই জাবি শাখা ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। অপরজন হলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সমন্বয়ক আহসান লাবিব।
প্রাথমিকভাবে ঘটনার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে জড়িত ছয় ব্যক্তির পরিচয় জানা গেছে। এ ঘটনায় জড়িত বাকিদের পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা চলছে।
মারধরের সম্পৃক্ততার বিষয়ে সাঈদ বলেন, কেউ-ই হত্যার উদ্দেশ্যে তাকে মারধর করেনি। একজন সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে আমি দেখতে গিয়েছিলাম। আর একজন মানুষ, যিনি হেঁটে পুলিশের গাড়িতে গেছে আর কিছুক্ষণের মধ্যে মারা গেছেন, এর রহস্য উদ্ঘাটন করা জরুরি।
আরেক অভিযুক্ত রাজু আহমেদ বলেন, ‘আমি সাধারণ শিক্ষার্থীদের থেকে শোনার পর সেখানে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে আমি শামীমকে ধমক দিই, তাকে মারধর করিনি।’ অভিযুক্ত রাজন হাসান বলেন, ‘আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম; কিন্তু মারার জন্য সেখানে যায়নি। যারা তালা ভাঙার চেষ্টা করছিল তাদের আমি নিষেধ করেছিলাম।’ এ বিষয়ে হামিদুল্লাহ সালমান বলেন, ‘আমি সন্ধ্যায় হলে ছিলাম। পরে খবর পেয়ে প্রক্টর অফিসে যাই; কিন্তু শামীম মোল্লাকে মারধর করিনি।’ আরেক অভিযুক্ত সোহাগ বলেন, ‘আমি টিউশন থেকে ফেরার পথে হইচই দেখে সেখানে গেছিলাম; কিন্তু মারধর করিনি।’
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেট সংলগ্ন একটি দোকানে অবস্থান করছিলেন শামীম মোল্লা। তার অবস্থানের খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী সেখানে গিয়ে তাকে আটক করে গণপিটুনি দেয়। পরে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম উপস্থিত হয়। একপর্যায়ে নিরাপত্তা কর্মীদের সহায়তায় তাকে নিরাপত্তা শাখায় নিয়ে আসা হয়। এ সময় তাকে নিরাপত্তা অফিসে রাখা হলে গেটের তালা ভেঙে পুনরায় তার ওপর হামলা চালায় অভিযুক্তরা। মূলত এ হামলায় শামীম গুরুতর আহত হয়ে পড়েন। এরপর পুলিশের গাড়িতে তোলার সময় তৃতীয় দফায় তার ওপর হামলা চালানো হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহিন বলেন, শামীম মোল্লাকে প্রান্তিক গেটে হালকা মারধর করে প্রক্টর অফিসে নিয়ে আসা হয়। এরপর তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিরাপত্তা অফিসে নিয়ে গেলে সেখানে গেট ভেঙে তার ওপর হামলা করে শিক্ষার্থীরা। মূলত তখনই তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। তালা ভাঙার সময় আমি প্রক্টর অফিস থেকে বের হতে গেলে কয়েক শিক্ষার্থী আমাকে বাধা দেয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম রাশিদুল আলম বলেন, তদন্ত সাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় আইনে মামলা করা হবে।
ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীমের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশপাশের এলাকায় মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, জমি দখল, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। এসব ঘটনায় তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও রয়েছে। গত ১৫ জুলাই রাতে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় তিনি সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
আট শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার: শামীম মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িত আট শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কারের তথ্য ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ড. এ বি এম আজিজুর রহমান স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে জানানো হয়েছে। বহিষ্কৃতরা হলেন, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী মো. রাজন মিয়া, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৫ ব্যাচের শিক্ষার্থী রাজু আহম্মদ, ইতিহাস বিভাগের ৪৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ, ইংরেজি বিভাগের ৪৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী হামিদুল্লাহ্ সালমান, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের ৪৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী আতিকুজ্জামান আতিক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী সোহাগ মিয়া, বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী আহসান লাবিব এবং ইংরেজি বিভাগের ৫০ ব্যাচের শিক্ষার্থী মো. মাহমুদুল হাসান রায়হান। ভিডিও দেখে তাদের শনাক্তের কথা জানানো হয়েছে।