ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়েছে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ ‘এমভি আব্দুল্লাহ’। জাহাজে থাকা ২৩ নাবিক ও ক্রুকে জিম্মি করেছে জলদস্যুরা। জিম্মিদের মধ্যে আছেন নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার পাঁকা ইউনিয়নের সালাইনগর গ্রামের মো. জয় মাহমুদ। জিয়াউর রহমানের ছেলে জয় জাহাজের একজন ক্রু। মঙ্গলবার (১২ মার্চ) বিকেল ৪টায় মা-বাবার সঙ্গে জয় সর্বশেষ কথা বলেন।
জয়ের চাচাতো ভাই মারুফ হোসেন জানান, মঙ্গলবার বিকেল ৪টায় জয়ের মা-বাবা তার সঙ্গে সর্বশেষ কথা বলেন। পরে আমিও তার সঙ্গে কথা বলি। জয় জলদস্যুর কবলে পড়েছে বলে আমাকে জানায় এবং বিষয়টি কাকা-কাকির কাছে গোপন রাখতে বলে। সন্ধ্যা ৬টা ৩৯ মিনিটে জয় হোয়াটসঅ্যাপে জানায়, তাদের মোবাইল কেড়ে নেয়া হচ্ছে। এরপর আর কথা বলা যায়নি।
সন্ধ্যার পরে গণমাধ্যমে খবর প্রচার হলে এলাকাবাসী জলদস্যুর হাতে জয়ের জিম্মি হওয়ার বিষয়টি জানতে পারে। খবর প্রচারের পর জয়ের বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে। মারুফ হোসেন জানান, ছেলের অমঙ্গলের আশঙ্কায় রাত থেকে একটানা কেঁদেই চলেছেন জয়ের মা আরিফা বেগম।
তিনি বলেন, ‘জয়ের জাহাজ কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি শেষ খবর জানার জন্য।’
জয় মাহমুদরা দুই ভাই-বোন। জয় বড়। ২০২১ সালে তিনি জাহাজে চাকরি নেন। এরপর প্রশিক্ষণ শেষে চার মাস ছুটি কাটিয়ে জাহাজে ফেরেন।
জয়ের মা আরিফা বেগম বলেন, ‘আমার কলিজার টুকরা যেন সহিসালামতে থাকে। তাকে আমার বুকে ফিরিয়ে দাও মাবুদ।’
জয় মাহমুদের বাবা জিয়াউর রহমান বলেন, ‘আমার ছেলেসহ জিম্মি হওয়া সবাইকে দ্রুত উদ্ধার করা হোক, সরকারের কাছে এটাই আমার আবেদন।’
স্থানীয় ইউপি সদস্য মজিবর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের জাহাজ জলদস্যুদের কবলে পড়ার খবরে এলাকার মানুষ অজানা আশঙ্কায় সময় কাটাচ্ছেন। আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানাই, আটকা পড়াদের যেন দ্রুত উদ্ধার করা হয়।’
জাহাজটিতে জিম্মি থাকা নাবিক ও ক্রুরা হলেন- ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আব্দুর রশিদ, চিফ অফিসার মোহাম্মদ আতিকুল্লাহ খান, দ্বিতীয় কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম চৌধুরী, তৃতীয় কর্মকর্তা মো. তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট মো. সাব্বির হোসেন, প্রধান প্রকৌশলী এএসএম সাইদুজ্জামান, দ্বিতীয় প্রকৌশলী মো. তৌফিকুল ইসলাম, তৃতীয় প্রকৌশলী মো. রোকন উদ্দিন, চতুর্থ প্রকৌশলী তানভীর আহমদ, ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহিম খলিল উল্লাহ, এবি মো. আনোয়ারুল হক, এবি মো. আসিফুর রহমান, এবি সাজ্জাদ হোসেন, ওএস জয় মাহমুদ, ওএস মো. নাজমুল হক, ওএস আইনুল হক, অয়েলার মোহাম্মদ শামসউদ্দিন, মো. আলী হোসেন, ফায়ারম্যান মোশারফ হোসেন শাকিল, চিফ কুক মো. শফিকুল ইসলাম, জিএস মো. নূর উদ্দিন ও ফিটার মো. সালেহ আহমেদ।
সোমালিয়ান জলদস্যুর হাতে জিম্মি বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’ থেকে গোপনে জাহাজ মালিকের কাছে একটি অডিও বার্তা পাঠিয়েছেন চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান। ৩ মিনিট ৩৪ সেকেন্ডের ওই অডিও বার্তায় জলদস্যুদের কবলে পড়ার সম্পূর্ণ ঘটনাটি বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। একইসঙ্গে জানিয়েছেন জাহাজ ও তাদের বর্তমান পরিস্থিতিও।
আতিকুল্লাহ খান তার অডিও বার্তায় জানান, জাহাজটিতে খাবার পানির পরিমাণ কম। আবার জাহাজে যেসব কার্গো রয়েছে সেগুলোও বিপজ্জনক। রয়েছে অগ্নিঝুঁকিও। সোমালিয়ান জলদস্যুরা জাহাজে ওঠার পর কার সঙ্গে কী আচরণ করেছে তাও বর্ণনা করেছেন তিনি।
তার অডিও বার্তাটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
‘আসসালামুলাইকুম স্যার, আমি চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান বলছি।
আজকে সকালে জাহাজের সময় আনুমানিক সাড়ে ১০টার সময় একটা হাইস্পিড বোট আমাদের দিকে আসছিল। সঙ্গে সঙ্গে আমরা এলার্ম দিয়ে ব্রিজে গেলাম। ওখান থেকে পরে সিটে চলে গেলাম। ক্যাপ্টেন স্যার ও সেকেন্ড অফিসার ব্রিজে ছিল। আমরা ঝিকঝাক কোর্স করলাম। তারপর এএসএস-এ করলাম। ইউকে এমটিকেও ট্রাই করলাম। কিন্তু তারা ফোন রিসিভ করেনি। এর মধ্যে জলদস্যুরা চলে আসলো।
চলে আসার পর ওরা ক্যাপ্টেন স্যার ও সেকেন্ড অফিসারকে জিম্মি করে। আমাদের ডাকল। আমরা সবাই আসলাম। আমাদের ডেকে কিছু গোলাগুলি করল। আমরা একটু ভয় পেয়েছি। সবাই ব্রিজে বসে ছিলাম। কারো গায়ে হাত তোলেনি। শুধু সেকেন্ড অফিসারকে একটু মারধর করেছে। তারপর আরেকটি স্পিডবোটে করে আরও কয়েকজন চলে আসল। এভাবে মুহূর্তেই প্রায় ১৫-২০ জন চলে আসে।
এর কিছুক্ষণ পরে একটি বড় ইরানিয়ান ফিশিং বোট নিয়ে আরও জলদস্যু চলে আসে। ইরানিয়ান ওই ফিশিং বোটটি এক মাস আগে তারা জিম্মি করেছিল। এটি দিয়ে তারা এক মাস ধরে নতুন কোনো জাহাজ জিম্মি করার জন্য সাগরে ঘোরাঘুরি করছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা সামনে পড়ে গেলাম।
এই ফিশিং বোটের তেল শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমাদের জাহাজে থাকা পাম্প দিয়ে কিছু ডিজেল নিয়ে ওই বোটে দিয়েছে তারা। তেল দেয়ার পর আমাদের জাহাজে উঠে জিম্মি করা ফিশিং বোটটিকে ছেড়ে দেয়।
তারপর ওরা আমাদের সেকেন্ড ও থার্ড অফিসারকে নিয়ে জাহাজের ইঞ্জিন রুমে যায়। তাদের নিয়ে গিয়ে জাহাজের ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয়। এখন পর্যন্ত আল্লাহর রহমতে কারো কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। জাহাজের কোনো ক্ষতি হয়নি। আমাদেরও কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে সবাই ভয়ে আছি। ওরা খুব ভয় দেখাচ্ছে।
আমাদের জাহাজে ২০-২৫ দিনের খাবার পানি আছে। প্রায় ২০০ মেট্রিক টনের মতো। সবাইকে বলেছি, এগুলো একটু সাবধানে ব্যবহার করতে। শেষ হয়ে গেলে বিপদে পড়ব আমরা। তবে, একটা সমস্যা হচ্ছে আমাদের জাহাজে কিছু কোল্ড কার্গো আছে। প্রায় ৫৫ হাজার টন। এগুলো একটু ডেঞ্জারাসও। ফায়ারেরও ঝুঁকি আছে। মিথেন বাড়ে। লাস্ট যখন অক্সিজেন মেপেছি তখন ৯-১০ শতাংশ লেভেল পেয়েছি। এটি নিয়মিত মনিটরিং করতে হয়। কোনো কারণে অক্সিজেন লেভেল বেড়ে গেলে বিশেষজ্ঞের মতামত নিতে হবে। এটার একটু ব্যবস্থা করবেন, স্যার।
আমাদের জন্য দোয়া করবেন, স্যার। আমাদের পরিবারকে একটু দেখবেন, স্যার। সান্ত্বনা জানাবেন, স্যার। আসসালামুলাইকুম।’
২৩ বাংলাদেশি নাবিকসহ বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’ গত রোববার মোজাম্বিক থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিল। সোমবার ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে এটি। পণ্যবাহী জাহাজটির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান কবির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। মঙ্গলবার (মার্চ ১২) দুপুর ১টার দিকে জাহাজটি জলদস্যুদের কবলে পড়ার খবর জানতে পারে বাংলাদেশের অন্যতম শিল্পগোষ্ঠীটির কর্তৃপক্ষ।
প্রসঙ্গত, ‘গোল্ডেন হক’ নামের জাহাজটি কেএসআরএম গ্রুপের বহরে যুক্ত হওয়ার পরে এর নাম দেয়া হয় ‘এমভি আবদুল্লাহ’। গত বছর এটি সংগ্রহ করে সাধারণ পণ্য পরিবহন করতে থাকে কেএসআরএম গ্রুপ। ২০১৬ সালে তৈরি হওয়া জাহাজটি লম্বায় ১৯০ মিটার।
২০১১ সালে একই মালিকের ‘এমভি জাহান মনি’ নামের আরেকটি জাহাজ আটক করে সব নাবিক ও ক্রুকে জিম্মি করে সোমালিয়ান জলদস্যুরা।