বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় নিহতের ঘটনায় যেসব মামলা হচ্ছে তা নিয়ে এর মধ্যেই নানা ধরনের প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত ১৫ বছরে যেভাবে ঢালাওভাবে বিভিন্ন মামলায় বিএনপির নেতাকর্মী এবং বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়েছে সেই চর্চা এখনও চলছে বলে প্রশ্ন তুলছেন আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা।
সরকার বিরোধী আন্দোলন চলার সময় মৃত্যুর সংখ্যা জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী অন্তত সাড়ে ছয়শ জন। যদিও ওই সময় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় মৃত্যুর সংখ্যা এখনও প্রতিনিয়তই বাড়ছে।
কোটা আন্দোলন ও সরকার পতনের আন্দোলন ঘিরে জুলাই-অগাস্ট মাসে যেসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, তাকে ‘জুলাই গণহত্যা’ নামে অভিহিত করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কিন্তু এসব মৃত্যুর ঘটনায় যেসব হত্যা মামলা হয়েছে দেখা যাচ্ছে সেগুলোর এজাহারের ধরন প্রায় একই রকমের।
একইসাথে ঢালাওভাবে নাম উল্লেখ করে অসংখ্য আসামির পাশাপাশি প্রায় প্রতিটি মামলাতেই অজ্ঞাতনামা কয়েক হাজার আসামি করা হয়েছে। ফলে এসব মামলা প্রমাণ করে বিচার কতটা নিশ্চিত করা যাবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীদের।
এছাড়া এসব মামলার তদন্ত নিয়েও শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন আইনজীবীরা।
পাঁচই অগাস্টের আগে থানায় করা মামলা প্রশ্নবিদ্ধ
জুলাইয়ের শুরুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন তুঙ্গে, ওই সময় নিহতের বেশ কিছু ঘটনায় থানায় মামলা করা হয়েছে। পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের আগে থানায় অন্তত ৩৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
জুলাই মাসে বিভিন্ন সময়ে থানায় যেসব মামলা করা হয়েছে সবগুলোর এজাহারেই কোটাবিরোধী অজ্ঞাতনামা আন্দোলনকারী, জামায়াত – শিবির এবং বিএনপি কর্মীদের আসামী করা হয়েছিল।
কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে গত ১৬ই জুলাই সহিংসতায় নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষে এক শিক্ষার্থীসহ অন্তত দু’জন নিহত হন। এ ঘটনায় নিহতদের স্বজনরা বাদী হয়ে নিউমার্কেট থানায় দু’টি হত্যা মামলা দায়ের করে। নিহত দু’জন হলেন শাহজাহান আলী এবং সবুজ আলী।
পৃথক ওই দু’টি মামলার অভিযোগেই বলা হয়েছে, ঘটনার দিন অজ্ঞাতনামা কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা জামায়াত, শিবির ও বিএনপি নেতা-কর্মীরা এক হয়ে সায়েন্স-ল্যাব ক্রসিং থেকে বিভিন্ন স্লোগান দিতে দিতে লোহার রড, হকিস্টিক, লাঠি-সোটা ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্রসহ নিউমার্কেটের দিকে এগিয়ে আসে।
পরে অজ্ঞাতনামা কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী, শিবির এবং বিএনপি নেতাকর্মীরা রড, লাঠি এবং অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে ভিকটিমদের ওপর আক্রমণ করে বলে দুটি অভিযোগেই বলা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার আবেদন করা হয়েছে এসব অভিযোগে। মামলার বাদী নিহত শাহজাহান আলীর মা আয়শা বেগম।
নিহত শাহজাহানের বাবা ইমাম হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ঘটনার সময় আমার ওয়াইফ খুব অসুস্থ ছিল। আমরা জানতাম না এজাহারে কি ছিল। ওইখান থেকে দিয়েছিল। পরে যখন জেনেছি আমরা থানায় গিয়ে ওইটা ঠিক করাইছি”।
সপ্তাহ দেড়েক আগে পূর্বের এজাহার পরিবর্তন করা হয় জানিয়ে মি. হোসেন বলেন “ বহুত গ্যাঞ্জাম হইছে এটা নিয়ে। প্রথমে এজাহার ঠিক করতে চায় নাই পুলিশ। পরে যখন বলি সংবাদ সম্মেলন করবো তখন তারা ঠিক করতে রাজী হয়। ”
“বিএনপি -জামায়াত এটার সঙ্গে জড়িত ছিল না, কেন তাদের দিছেন এটা বলছি তাদের। পরে এজাহারে সালমান এফ রহমান, আনিসুল হক এবং মেজর জিয়াউল হক জিয়াকে আসামি করা হইছে। ওই এজাহার আদালতে পাঠানো হয়েছে”।
অথচ এ মামলার এজাহারে আসামি কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী, জামায়াত – শিবির এবং বিএনপি কর্মীরা আসামি হলেও সালমান এফ রহমান, আনিসুল হককে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে ১৪ই অগাস্ট রিমান্ডেও নেয়া হয় তাদের।
কিন্তু পরবর্তীতে সপ্তাহ খানেক আগে এ মামলায় সংশোধিত এজাহার আদালতে জমা দেয়া হয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সজীব মিয়া বলেন, “ মামলার বাদী এজাহারে সংশোধনী দিয়েছেন। সংশোধনী এজাহার থানা থেকে আদালতে পাঠানো হয়েছে”।
‘ফৌজদারি মামলায় এফআইআর বাইবেল’
আইনজীবীরা বলছেন, ফৌজদারি মামলায় এফআইআর বা এজাহারকে মামলার মৌলিক ভিত্তি বলে মনে করা হয়। এর কোন শব্দ পরিবর্তন করা যায় না। কিন্তু সংশোধিত এজাহার বলে কিছু নেই। এটি বিচারে গ্রহণযোগ্য হয় না। সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, “ এজাহার একবারই হয়। এগুলো কিছুতেই কোর্টে টিকবে না”।
“ক্রিমিনাল কেইস হলো স্থান, সময় এবং ঘটনা সংঘটনের স্থান। এই তিনটার হেরফের হলে তাহলে আর টেকে না। আর ফৌজদারি মামলায় এফআইআর বাইবেল হিসেবে পরিগণিত হয়। অর্থাৎ এর সামান্য দাড়ি, কমা পরিবর্তন হলে এটা বাদ”।
তদন্তে আরো নতুন নতুন তথ্য আসতে পারে জানিয়ে আইনজীবী বলেন, “ তদন্তে ফারদার তথ্য আসতে পারে। কিন্তু এফআইআর দুইটা হতে পারে না। দু’টা হলে এটা ভুয়া বলে প্রমাণিত হওয়ার সুযোগ থাকে। এক মামলায় দুই এফআইআর হতেই পারে না।” এর ফলে এসব মামলা আগেই দুর্বল হয়ে যায় বলে মনে করেন এ আইনজীবী।
সুপ্রিম কোর্টের আরেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক মনে করছেন, এ ধরনের সংশোধনীর কারণেই মামলা ইতোমধ্যেই আইনগতভাবে দুর্বল হয়ে গেছে। “এসব মামলায় বর্তমানে যে মন্ত্রীদের অভিযুক্ত করা হচ্ছে,বিচার করে তাদের দোষী সাব্যস্ত করার সম্ভাবনা খুবই কম ” বলেন মি. মালিক।
ক্রিকেটার সাকিবের বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে আলোচনা
ঢাকার আদাবর থানায় গার্মেন্টস কর্মী রুবেল হত্যা মামলায় বিশ্ব সেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে আসামি করা হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ আরো ১৫৬ জনকে এ মামলায় আসামি করা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আসামি চারশো থেকে পাঁচশো জন। এজাহারে ২৮ নম্বর আসামি ক্রিকেটার সাকিব।
এতে বলা হয়েছে, গত পাঁচই অগাস্ট রুবেল আদাবরের রিং রোডে প্রতিবাদী মিছিলে অংশ নেন। এ সময় পরিকল্পিতভাবে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দাঙ্গা সৃষ্টি করে বেআইনিভাবে উস্কানি ও নির্দেশে কেউ মিছিলে গুলি ছোড়ে। বুক ও পেটে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রুবেলকে হাসপাতালে নেয়া হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত সাতই অগাস্ট মারা যান তিনি।
সর্বশেষ সাতই জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতীকে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। বাদীর অভিযোগ, ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য হিসাবে হত্যার ঘটনায় পরোক্ষ প্ররোচনার দায় আছে সাকিব আল হাসানের।
তবে এ মামলার খবর প্রকাশিত হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে তুমুল সমালোচনা হয়। জাতীয় দলের ক্রিকেটাররাও এর তীব্র সমালোচনা করে ফেসবুকে পোস্ট দেন। রাওয়ালপিন্ডি টেস্টের মধ্যেই ঢাকায় এ মামলা হয়েছে। বাংলাদেশ পাকিস্তানকে হারিয়ে দশ উইকেটে জয়লাভ করে এ টেস্টে।
টেস্ট দলের আরেকজন ক্রিকেটার এবং সাবেক অধিনায়ক মুমিনুল হক ফেসবুকে এ মামলাটিতে ‘মিথ্যা মামলা’ অভিহিত করে টেস্ট দিয়েছেন।
তিনি লিখেছেন, “গার্মেন্টস কর্মী হত্যা মামলার দায়ে অভিযুক্ত সাকিব ভাই তখন কানাডায় খেলছিলেন। দেশেও ছিলেন না লম্বা সময়। সাকিব ভাইয়ের নামে এমন মামলা অপ্রত্যাশিত। এমন ঘটনা দেশের ক্রিকেটের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে পারে” লিখেছেন মমিনুল।
ঘটনার সময় দেশে না থাকলেও এভাবে ঢালাওভাবে আসামি করায় এরকম মামলার ভবিষ্যত খুবই অন্ধকার বলে মনে করছেন আইনজীবীরা। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেনের মতে এ ধরনের মামলা ছাত্র আন্দোলনের ফসলকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। অনেকদিনকার যে চর্চা এসব মামলায় তারই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
“যেভাবে মামলাগুলো সাজানো হচ্ছে, কন্ট্রাডিকটরি যদি সাজানো হয়, যা হয়েছে সঠিকভাবে সেটা না বলে অন্য কাহিনী যদি এখানে আসে তখনতো এদের সঠিক বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়। ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে মামলাগুলো” বলেন মিজ হোসেন।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসা-বশত মামলায় জড়ানোর অনেক দিনের যে চর্চা এগুলোও এসব মামলাতে প্রতিফলিত হচ্ছে জানিয়ে মিজ হোসেন বলেন, “ এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এতো পরিবার যারা স্বজন হারিয়েছে, ছেলেমেয়ে হারিয়েছে তারা বিচার পাবে না, যদি এভাবে চলে, এটাই প্রধান উদ্বেগ”।
মামলাগুলো প্রমাণ করা যাবে কি?
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে আন্দোলনের সময় মৃত্যুর ঘটনায় থানায় ও আদালতে শেখ হাসিনাসহ তার মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হচ্ছে।
এসব হত্যা মামলায় ঢালাওভাবে অনেককে আসামি করা হচ্ছে। নাম উল্লেখ করা ছাড়াও এসব মামলায় অজ্ঞাতনামা কয়েকশ জনকে আসামি করা হয়েছে।
এর আগে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এভাবে ঢালাওভাবে বিভিন্ন মামলায় বিএনপির নেতাকর্মী এবং বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের আসামি করার নজির রয়েছে।
ফলে গত কয়েকদিন ধরেই আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মীরা এ ধরনের ঢালাও মামলায় উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। তারা বলছেন, আওয়ামী লীগ আমলের মতোই আবারো একই প্যাটার্নে, প্রায় একই ধরনের মামলা করা হচ্ছে।
শাহদীন মালিক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপিসহ বিরোধী নেতাকর্মীদের দৌড়ের উপর রাখার জন্য এভাবেই মামলা করা হতো। একেকজনের বিরুদ্ধে শ’খানেক মামলাও ছিল। ”
“কোন মামলায় বিচার করে তাদের দোষী প্রমাণ করতে পারে নি। সেসব মামলায় দোষী প্রমাণ করা উদ্দেশ্য ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল বিএনপি নেতাকর্মীদের দৌড়ের উপরে রাখা। উদ্দেশ্য ছিল তাদের ভয়-ভীতি দেখানো, তটস্থ রাখা”।
বিচার নিশ্চিতের জন্য ফৌজদারি মামলা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে হবে বলে জানান মি. মালিক।
“ফৌজদারি মামলায় সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে হবে যে ওই ব্যক্তি ওই অপরাধের সাথে জড়িত ছিল। আমি যে হত্যা করেছি এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে হবে” বলেন মি. মালিক।
মালিকের মতে, “ একটা হত্যা মামলায় কি ৫০ জন জড়িত থাকতে পারে? এর থেকে আজগুবি, গাঁজাখুরি আর কী হতে পারে? এসব কারণেই মামলা প্রমাণ করা আরো কষ্টসাধ্য হবে।”
পুলিশের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন
পুলিশের যোগ্যতা এবং দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন আইনজীবীরা। গত ১৫ বছরে যেভাবে গৎবাঁধা মামলা পুলিশ করেছে তাতে ওই অভ্যাস থেকে বেরিয়ে যথার্থ ভাবে মামলা করা ও তদন্ত করা তাদের পক্ষে সম্ভব কিনা এমন প্রশ্নও তুলছেন তারা।
“পুলিশের অদক্ষতা, অযোগ্যতা এবং হয়রানি, হেনস্থা করার জন্য গত একযুগ ধরে মামলা হয়েছে। ফলে আইনগতভাবে কীভাবে মামলা করতে হয়, আমার আশঙ্কা বেশিরভাগ পুলিশ তা ভুলেই গেছে” বলেন মি. মালিক।
একই সাথে এসব হত্যা মামলায় অতীতের মতোই অসংখ্য আসামি করায় তদন্ত দুরূহ হয়ে পড়বে এবং যথাযথ তদন্ত করা সম্ভব হবে না বলে তিনি মনে করেন।